বুদ্ধদেব বসু (৩০ নভেম্বর, ১৯০৮) ছিলেন একজন অসামান্য বাঙালি সাহিত্যিক, যিনি কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, সম্পাদকতা এবং সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাদৃত। বিংশ শতাব্দীর বিশ এবং ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী অন্যতম কবি হিসেবে তিনি পরিচিত।
বুদ্ধদেব বসু: ব্যক্তিগত জীবন
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়, যা তখন পূর্ববঙ্গের অংশ ছিল। তাঁর পিতা ভূদেব বসু ঢাকা বারের উকিল ছিলেন এবং মাতা বিনয়কুমারী। তাঁর জন্মের মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাতা বিনয়কুমারীর মৃত্যু ঘটে। শোকসন্তপ্ত পিতা ভূদেব সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং বুদ্ধদেব মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ’র কাছে প্রতিপালিত হন। কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ঢাকায় তাঁর শৈশব এবং কৈশোর কাটে। বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী ছিলেন প্রতিভা সোম (বিবাহের পর প্রতিভা বসু)।
শিক্ষাজীবন
বুদ্ধদেব বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯১৮ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সচ্চিদানন্দ ইনস্টিটিউশনে। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৩০ সালে বি.এ অনার্স এবং ১৯৩১ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং মেধাবী।
কর্মজীবন
বুদ্ধদেব বসুর কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। প্রথমদিকে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য দু’বার প্রত্যাখ্যাত হলেও পরবর্তীতে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের গভীর পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। কলকাতা রিপন কলেজে ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে দিল্লি ও মহিশূরে কাজ করেন এবং ১৯৫৩ সালে পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন। এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন।
সাহিত্যকর্ম
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যে অবদান অসাধারণ। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি যেমন মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), পৃথিবীর পথে (১৯৩৩) এবং দময়ন্তী (১৯৪৩) আধুনিক কাব্যরীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লাল মেঘ (১৯৩৪) এবং তিথিডাের (১৯৪৯) উল্লেখযোগ্য। বুদ্ধদেব বসুর নাটকগুলির মধ্যে কলকাতার ইলেক্টা, প্রথম পার্থ, তপস্বী এবং তরঙ্গিণী উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে হঠাৎ-আলাের ঝলকানি (১৯৩৫), কালের পুতুল (১৯৪৬) এবং রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য (১৯৫৫) উল্লেখযোগ্য।
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যে মৌলিকতার পরিচয় যেমন দেখা যায়, তেমনি তিনি সমালোচনামূলক সাহিত্যে মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গদ্য এবং পদ্যের রচনাশৈলী ছিল স্বতন্ত্র এবং মনোজ্ঞ।
সম্মাননা
বুদ্ধদেব বসু তার সাহিত্যকর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তপস্বী ও তরঙ্গিণী কাব্যনাট্যের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৭৪ সালে স্বাগত বিদায় গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
উপসংহার
বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবর্তক হিসেবে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যকর্মের গভীরতা ও বৈশিষ্ট্য তাঁকে একটি অনন্য স্থান দান করেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এবং তাঁর লেখা প্রতিটি পংক্তি বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও প্রসারে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।