Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ: বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অমোচনীয় অধ্যায়

বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু অধ্যায় আছে যা জাতির জীবনে চিরস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামের পাশাপাশি, এর একটি করুণ অধ্যায় হচ্ছে “দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ”। এটি শুধুমাত্র একটি শিরোনাম নয়, এটি একটি নির্যাতন, নিপীড়ন এবং অসম্মানের প্রতীক। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতায় যেভাবে লক্ষাধিক বাঙালি নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা ইতিহাসের এক নির্মম কাহিনী।

‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের  তথ্যভিত্তিক এই বইটির লেখক উপমহাদেশের  সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল অ্যান্থনিসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে’ এই মর্মে সংবাদ পরিবেশনের জন্য। কিন্তু, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস বর্বরতা হতবাক করে তাঁকে,স্তম্ভিত হয়ে ভাবেন এ বর্বরতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার কথা। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে তিনি হিটলার ও নাৎসীবাদের অমানুষিক বর্বরতার চেয়েও ভয়াবহ বলে বইটির ভূমিকায় লিখেছেন। তাই, তিনি এ অমানবিক নৃশংসতার চিত্র বিশ্ববাসীকে জানানোর সংকল্প নিয়ে ১৯৭১ এর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি সবকিছু তুলে ধরেন ‘সানডে টাইমস’এ; ১৯৭১ এর ১৩ই জুন ‘সানডে টাইমস’ পাকিস্তানের গণহত্যার সম্পূর্ণ কাহিনী ফাঁস করে দেয়।

অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস এই বইতে খুব নিপুণাকারে ’৬৯ এর ২৬ মার্চে ইয়াহিয়া খানের গদিতে বসা থেকে শুরু করে ’৭১ এর এপ্রিল পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন পাকবাহিনীর নৃশংসতাকে। লিখেছিলেন স্বাধীনতা আর দুর্বিপাকের গল্পগুচ্ছ নিয়ে।
পুরো বইটিকে তিনি বেশ কিছু অধ্যায় অথবা পর্ব বিভক্ত করেছেন, উল্লেখযোগ্য অধ্যায়গুলো:
(ক) পাকিস্তানের দুর্বিপাকের পূর্ববঙ্গ,
(খ) পাকিস্তান পতনের কারণগুলোর যৌক্তিকতা,
(গ) পাকিস্তানে সংঘর্ষের মূল কারণগুলো,
(ঘ) অর্থনৈতিক বৈষম্য,
(ঙ) পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিশ্বাসঘাতকতা,
(চ) এক নতুন সূচনা পর্ব,
(ছ) ১৯৭০: নির্বাচন-পূর্ব টালবাহানা,
(জ) ১৯৭১ : নির্বাচনোত্তর প্রহসন,
(ঝ) পাক-সামরিক বাহিনীর অভিযান,
(ঞ) অবিস্মরণীয় পঁচিশ দিন,
(ট) গণহত্যা,
(ঠ) গোয়েবলসের পুনরাগমন,
(দ) আশি লাখ লোক কেন মারা যাবে?
(ধ) কেন বাংলাদেশ? সহ বেশকিছু।

১. পটভূমি: মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানি শাসন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। ভাষার প্রশ্নে শুরু হওয়া সংগ্রাম ক্রমেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্নে পরিণত হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে উপেক্ষা করছিল এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর অত্যাচার চালাচ্ছিল।

এরই মধ্যে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ ফলাফলকে মানতে নারাজ। একে কেন্দ্র করে শুরু হয় উত্তেজনা, যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এক চূড়ান্ত নিপীড়ন শুরু হয়। এই বর্বর অভিযানে লক্ষাধিক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়, আর বাঙালি নারীদের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের কালো ছায়া।

২. নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) লক্ষাধিক বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে। এই গণধর্ষণ ছিল একটি সুপরিকল্পিত কৌশল, যার লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে মানসিকভাবে দুর্বল করা, তাদের মনোবল ভেঙে ফেলা এবং এক ধরনের ‘সমাজিক শুদ্ধিকরণ’ বা ‘জাতিগত পরিবর্তন’ ঘটানো।

জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই গণধর্ষণের ঘটনার উপর বার বার আলোকপাত করেছে। তবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি, কারণ এটি ছিল বাঙালি সমাজের জন্য এক অসহনীয় দুঃখের অধ্যায়। অনেকেই সেই সময়ের নির্যাতিত নারীরা আজও সমাজের বৈরিতার মুখোমুখি।

এই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে বাঙালি নারীদের উপর এ ধরনের বর্বরতা চালায়:

  • মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ: ধর্ষণকে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। নারীদের উপর এ ধরনের অত্যাচার করে তারা পরিবারগুলোর মনোবল ভাঙার চেষ্টা করেছিল।
  • জাতিগত পরিবর্তন: পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি নারীদের গর্ভবতী করে ‘শুদ্ধ’ পাকিস্তানি জাতির জন্ম দিতে চেয়েছিল, যা ছিল তাদের এক ধরণের জাতিগত ‘শুদ্ধি’ প্রচেষ্টা।
  • দমনমূলক কৌশল: নারীদের ধর্ষণের মাধ্যমে পুরো বাঙালি জাতিকে একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছিল যে, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ফল কী হতে পারে। এটি ছিল একটি নির্যাতনমূলক ক্ষমতা প্রদর্শনের কৌশল।

৩. ধর্ষিতাদের সংখ্যা এবং প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন সূত্র মতে, প্রায় ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। তবে এই সংখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সংখ্যাটি আরও বেশি বলে ধারণা করে, যদিও এর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে অনেক ধর্ষিতা নারী আত্মহত্যা করেন, কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সমাজের ভয়ে ও লজ্জায় বহু নারী এ কথা প্রকাশ করেননি। এই সময়ের নারীরা “বীরাঙ্গনা” নামে খ্যাতি পেলেও, সমাজ তাদেরকে সেই সম্মান দেয়নি। বরং, তাদেরকে অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা ও অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই মহিলাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান নিজে তাদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন এবং তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেন। তবে সমাজের সামগ্রিক মানসিকতা পরিবর্তিত হয়নি। সমাজের অনেক স্তরেই তারা বৈষম্যের শিকার হন।

৪. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

“দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। যুদ্ধের সময় এমন বর্বরতা চালানোর জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রতি আন্তর্জাতিক মহল তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। আমেরিকান সাংবাদিক এবং গবেষকরা তাদের রিপোর্টে এই নারকীয় অপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক ওয়াল্টার ক্রোনকাইট এবং সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এই ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা সারা বিশ্বে প্রচার করেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা পাকিস্তানি বাহিনীর এ ধরনের বর্বরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এই ধরনের অপরাধের বিচার করা থেকে বিরত থাকে।

৫. বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে

স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে যুদ্ধাহত ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সরকার বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তবে এটির সফল বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। প্রথমত, সমাজে ধর্ষিতাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতার শিকার হওয়া নারীদের অনেকেই মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। সরকারিভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ থাকলেও, সামাজিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, অনেক বীরাঙ্গনা তাঁদের জীবনের এই অংশটিকে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, কারণ তাঁরা জানতেন যে সমাজ তাঁদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এতে তাঁদের মানসিক কষ্ট আরও বেড়ে যায়। তবে, কিছু বীরাঙ্গনা সাহসের সাথে তাঁদের কাহিনী প্রকাশ করেন এবং তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য সম্মান পেয়েছেন।

৬. পাকিস্তানের বিচারহীনতা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত এই ধর্ষণ ও নির্যাতনের জন্য পাকিস্তান সরকার কখনোই কোনো আনুষ্ঠানিক দায় স্বীকার করেনি। এমনকি পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা কোনো ধরনের শাস্তিও পাননি। বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক মহলে এই অপরাধের বিচার দাবি করেছে, তবে এর কোনো কার্যকরী ফলাফল দেখা যায়নি।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন” প্রণয়ন করে, যার আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। তবে, এতে শুধুমাত্র বাংলাদেশে থাকা দোসরদেরই বিচার হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়নি, কারণ তারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল এবং পাকিস্তান সরকার তাদের সুরক্ষা প্রদান করেছিল।

৭. বীরাঙ্গনাদের বর্তমান পরিস্থিতি

আজও, মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের অনেকেই সমাজে সমান মর্যাদা পান না। যদিও রাষ্ট্র তাঁদেরকে সম্মান দিয়েছে, কিন্তু সমাজ তাঁদেরকে সেভাবে গ্রহণ করেনি। অনেক বীরাঙ্গনা বেঁচে নেই, আর যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা অনেকেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। তাঁদের কষ্ট এবং ত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বলে মনে করেন অনেকে।

৮. “দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” এর প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা

“দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয়, এটি একটি শিক্ষা। যুদ্ধের সময় নারীদের উপর যে নিষ্ঠুরতা নেমে আসতে পারে, তা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে যে স্বাধীনতা অর্জন করতে কত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

এ ধরনের ঘটনা জাতীয় পরিচয়ের জন্য একটি চিরস্থায়ী ক্ষত। তবে এটিকে শুধু শোক হিসেবে নয়, বরং এক ধরনের দায়িত্ব হিসেবেও দেখা উচিত।যুদ্ধের সময় সংঘটিত এ ধরনের বর্বরতা যেন আর কখনো না ঘটে, সে জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সমস্ত বীরাঙ্গনা নারী নিজেদের সম্মান এবং জীবন দিয়ে জাতিকে রক্ষা করেছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

৯. প্রতিরোধমূলক শিক্ষা এবং সামাজিক দায়িত্ব

বীরাঙ্গনাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং তাঁদের যথাযথ সম্মান প্রদান করা আমাদের দায়িত্ব। একটি জাতি হিসেবে আমরা যদি তাঁদের অবদানকে শ্রদ্ধা না করি, তবে আমাদের ইতিহাসের সেই মহান অধ্যায়কে পূর্ণতা দেওয়া সম্ভব নয়।

আজকের বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন এবং অধিকার নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং অসম্মানের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের সঠিকভাবে সম্মান জানানো হয়নি। তাঁরা শুধু এককভাবে ভুক্তভোগী নন, বরং পুরো জাতির পক্ষ থেকে যে মানসিক যন্ত্রণা তাঁরা সহ্য করেছেন, তা আমাদের সকলের বোঝা উচিত।

বীরাঙ্গনাদের কাহিনী থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। সমাজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নারী স্বাধীনভাবে এবং সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে। যুদ্ধের সময় নারীদের উপর চালানো বর্বরতার পুনরাবৃত্তি যেন আর কখনো না ঘটে, সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

১০. স্মরণ এবং শ্রদ্ধা

“দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” শুধুমাত্র এক কালো অধ্যায় নয়, এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার জন্য কত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। যুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীরা কেবল ভুক্তভোগী নন, তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য প্রতীক। তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা তাঁদের অবদানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারব।

জাতির মুক্তির ইতিহাসে এই অধ্যায়টি যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, সেজন্য বীরাঙ্গনাদের স্মৃতি এবং কাহিনীকে আরও বেশি করে চর্চা করা প্রয়োজন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ কথা জানাতে হবে যে, বীরাঙ্গনারা আমাদের স্বাধীনতার পথে কতটা বড় ভূমিকা রেখেছেন এবং তাঁদের সেই অবদানের কথা কোনোদিনও ভোলা উচিত নয়।

এখনো অনেক বীরাঙ্গনা জীবিত আছেন, এবং তাঁদের সাহসিকতা আমাদের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতার জন্য তাঁদের আত্মত্যাগ এবং সহ্য করা যন্ত্রণার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা থাকা উচিত।

১১. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি

বাংলাদেশে এখনো মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং তথ্যসংগ্রহের প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলকে এ বিষয়ে আরও সচেতন করা জরুরি, যাতে যুদ্ধের সময় নারীদের প্রতি যে সহিংসতা চালানো হয়েছিল, তা যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করা যায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে “দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থাকবে। এটি আমাদের পরিচয়ের অংশ, যা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই অর্জিত হয়নি, বরং তা অর্জিত হয়েছে নারীদের শরীর ও মানসিকতার উপর চালানো নির্যাতনের মাধ্যমে।

জাতীয়ভাবে আমাদের উচিত এই অধ্যায়কে শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিকভাবে জানে যে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা কেমন নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল এবং কত বড় ত্যাগ স্বীকার করে আমরা আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি।

১২. সমাপ্তি: অতীত থেকে শিক্ষা, ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা

“দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” ইতিহাসের একটি নির্মম সত্য, যা আমরা ভুলতে পারি না। এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধের সময় নারীরা কেবল ভুক্তভোগী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সাহসের প্রতীক। তাঁদের লড়াই শুধু স্বাধীনতার জন্য নয়, ছিল বেঁচে থাকার এবং জাতীয় পরিচয় রক্ষার লড়াই।

বীরাঙ্গনাদের এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি। তবে সেই স্বাধীনতার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে এবং এই নারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করতে হবে।

আজকের বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য এই করুণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নারীরা তাঁদের সবকিছু হারিয়েছিলেন, তাঁদের সম্মানিত করতে পারলেই আমরা সঠিকভাবে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে মূল্যায়ন করতে পারব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে যে নারীরা তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের আমরা কখনোই ভুলে যেতে পারি না। তাঁদের এই আত্মত্যাগ আমাদের মননে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে, এবং তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে চিরকাল। “দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ” ইতিহাসের একটি নির্মম অধ্যায় হলেও, এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমরা কত বড় ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখন আমাদের দায়িত্ব এই স্বাধীনতা এবং মর্যাদাকে রক্ষা করা, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো নারীকে এ ধরনের নির্মমতার শিকার না হতে হয়।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মহিলা কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য, মানবিক অনুভূতি, প্রেম, বিরহ, এবং সমাজের বিভিন্ন দিকগুলো

Read More

মুহম্মদ আবদুল হাই এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ নভেম্বর ১৯১৯ – ৩ জুন ১৯৬৯) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক। তার গবেষণা এবং কর্ম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

Read More

ন্যায় দর্শনের বিষয়বস্তু: ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? ন্যায় দর্শন কী বা কাকে বলে? ন্যায় দর্শনের কয়টি শাখা ও কি কি?

ন্যায়দর্শন হচ্ছে ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম একটি দর্শন। ন্যায়দর্শন হল সেই ভিত্তি যার উপর ভারতের উচ্চতর দর্শনগুলি নির্মিত হয়েছে। ন্যায় দর্শনের প্রবক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি

Read More

বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৮ সালের কার্তিকে, ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায়। কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে। নজরুলের বিদ্রোহী

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.