Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’: যুদ্ধ, প্রেম এবং মানবতার মহাকাব্য

War and Peace Summary and Analysis : লিও তলস্তয়, রাশিয়ার সাহিত্যের এক অমর ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। মানবজীবনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সামাজিক বাস্তবতা এবং দার্শনিক চিন্তাধারার মিশেলে তিনি এমন সব রচনা সৃষ্টি করেছেন, যা আজও পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে আলোচিত। তাঁর রচিত “ওয়ার এন্ড পিস” ও “আন্না কারেনিনা” শুধু সাহিত্যিক কীর্তিই নয়, বরং মানবিকতা, প্রেম, নৈতিকতা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতাকে কেন্দ্র করে একটি আদর্শ মানবদর্শনের প্রতিফলন। ১৯ শতকের রুশ সমাজ, রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিলতা তাঁর লেখায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তলস্তয়ের সাহিত্যে শুধু রুশ সমাজই নয়, বরং পুরো মানবজাতির যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে। তাঁর সাহিত্যকর্ম তাই সর্বজনীন, যা যুগ যুগ ধরে পাঠকের মনে অনুরণন তৈরি করে চলেছে।

“ওয়ার এন্ড পিস” উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১২ সালের রাশিয়া ও ফ্রান্সের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা একটি কাল্পনিক কাহিনী। এই উপন্যাসে সেই সময়ের অভিজাত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে যুদ্ধকে চিত্রিত করা হয়েছে। ফরাসী অভিজাত শ্রেণীর জীবনের মাধ্যমে তলস্তয় যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সমাজের পরিবর্তন তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরু সেন্ট পিটার্সবার্গের আনা পাভলোভনার বাড়িতে এক সামাজিক আড্ডা থেকে, যেখানে প্রিন্স আন্দ্রু, পিয়ের বেজুখভ, প্রিন্স ভাসিলি ও রুস্তভের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো ক্রমান্বয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। কাহিনীর বিভিন্ন অংশে তলস্তয় তাঁর দার্শনিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসে ফরাসী অভিজাত শ্রেণীর সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে নেপোলিয়ন এবং সম্রাট আলেক্সান্ডারের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ, সন্ধি, এবং নেপোলিয়নের মস্কো অভিযানও প্রতিফলিত হয়েছে। নেপোলিয়নের শক্তিশালী সেনাবাহিনী, যা প্রায় ছয় লাখ সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত, একের পর এক রাশিয়ার অঞ্চলগুলো দখল করতে থাকে, যখন রাশিয়ার সৈন্যরা প্রতিঘাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। বরদিনোর যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনী কড়া প্রতিরোধ গড়লেও, ফরাসীরা অবশেষে মস্কো দখল করতে সক্ষম হয়। যদিও রাশিয়ার সেনাপতি কুতুজভ বরদিনোর যুদ্ধে বিজয়ের দাবি করেছিলেন, অনেকেই তা মেনে নিতে পারেননি।

মস্কোর পতনই ফরাসিদের জন্য পরাজয়ের সূচনা করে। যদিও নেপোলিয়ন ভেবেছিলেন মস্কোর দখলের পর রাশিয়ার সম্রাট আলেক্সান্ডার তার বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং তিনি ইউরোপজুড়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন, তবে বাস্তবে ঘটেছিল উল্টো। মস্কো দখলের পর নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী লুটপাট শুরু করে এবং মস্কো পরিণত হয় ছাই ও ধোঁয়ার নগরীতে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে—কেউ মনে করেন এটি ফরাসীদের কাজ, আবার অনেকে বলেন এটি রুশদের পরিকল্পিত। যাই হোক, অগ্নিকাণ্ডের ফলে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী রসদ সংকটে পড়ে এবং প্রচণ্ড ঠান্ডায় তাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করে।

নেপোলিয়ন বাধ্য হয়ে মস্কো ত্যাগ করে এবং একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তা ধরে ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তীব্র শীত ও রসদের অভাবে তাঁর সেনাবাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফরাসি বাহিনী যখন রাশিয়া ছাড়ে, তখন সম্রাট আলেক্সান্ডার ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হন এবং মিত্রশক্তির সহায়তায় নেপোলিয়নকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করেন।

এই যুদ্ধের পাশাপাশি উপন্যাসে পৃথিবীর কিছু অনন্য প্রেমের কাহিনীও স্থান পেয়েছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে লেখক বর্ণনা করেছেন প্রিন্স অন্দ্রু, নাতাশা, পিয়ের, রুস্তভ ও প্রিন্সেস মারির প্রেমের গল্প। সোনিয়ার আত্মত্যাগ, অন্দ্রুর মৃত্যু এবং তার প্রতি নাতাশার অগাধ ভালোবাসার চিত্রও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে ফুটে উঠেছে। প্রিন্স অন্দ্রু শেষ দিনগুলো প্রিয়তমার সান্নিধ্যে কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিয়েরের নাতাশার প্রতি সুপ্ত ভালোবাসা পরবর্তীতে তাদের সংসার জীবনে রূপ নেয়, যা উপন্যাসের শেষাংশে বর্ণিত হয়েছে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় তথা শেষ পরিশিষ্টে, তলস্তয় যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর দার্শনিক চিন্তা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জাতি ও মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখানোই ইতিহাসের মূল লক্ষ্য। তাছাড়া, একটি ঘটনার অংশগ্রহণকারী সব মানুষের ইতিহাস লিখতে না পারা পর্যন্ত কোনো শক্তিকে মেনে না নিলে মানুষের অগ্রগতির সত্য বর্ণনা অসম্ভব।

“ওয়ার এন্ড পিস” উপন্যাসে যেমন যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি তলস্তয় দেখিয়েছেন যে যুদ্ধ কখনোই মানবতার জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যুদ্ধ হলো শান্তির বিরোধী। যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে হাজার হাজার গল্প, উপন্যাস, ও কবিতা রচিত হয়েছে, কিন্তু তলস্তয়ের “ওয়ার এন্ড পিস”-এর মতো সৃষ্টি বিশ্বে খুবই বিরল।

লিও তলস্তয়ের সাহিত্যকর্ম, বিশেষ করে “ওয়ার এন্ড পিস” ও “আন্না কারেনিনা”, তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। যুদ্ধ, প্রেম, মানবতার গভীরতা, এবং দার্শনিক চিন্তাধারার সমন্বয়ে তলস্তয় তাঁর রচনাগুলোতে শুধু সাহিত্যিক দক্ষতাই প্রদর্শন করেননি, বরং মানবজীবনের জটিল প্রশ্নগুলোর গভীরে প্রবেশ করেছেন। তাঁর লেখায় সামাজিক বাস্তবতা ও ব্যক্তিগত সংগ্রামের মধ্যে যে বৈপরীত্য, তা মানুষের নৈতিকতা ও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। তলস্তয়ের দৃষ্টিভঙ্গি শুধু রুশ সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তা সারা বিশ্বের মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল এবং আজও রয়েছে। তাঁর সাহিত্য তাই শুধু এককালের সাহিত্যিক সৃষ্টি নয়, বরং তা মানবজাতির চিরন্তন প্রশ্ন ও অন্বেষণের প্রতীক।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মোহিতলাল মজুমদার এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম: ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু: ২৬ জুলাই, ১৯৫২) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং প্রবন্ধকার। তিনি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি,

Read More

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্মঃ ২১ ডিসেম্বর, ১৮২৭— মৃত্যুঃ ১৩ মে, ১৮৮৭) বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং

Read More

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে কোন পত্রিকার মাধ্যমে? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা কে? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের স্লোগান কী ছিল?

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারবিরোধী একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে

Read More

কোন চিত্রশিল্পী পটুয়া নামে খ্যাত? চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান

চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান ‘পটুয়া’ নামে খ্যাত। কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর ১৯২১ – ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) প্রখ্যাত বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী। তিনি ড্রইং-এ দক্ষতা অর্জন করে বিশ্বব্যাপী সুনাম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.