Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি: সাহস, সংগ্রাম এবং একাকীত্বের মহাকাব্য

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের অমর সৃষ্টি “দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি” বিশ্বসাহিত্যের এক বিস্ময়কর উপাখ্যান। এ উপন্যাসে সাহস, সংগ্রাম এবং একাকীত্বের কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সামুদ্রিক জীবন, বয়সের ভার এবং অদম্য মনোবলের সমন্বয়—এ সবই এক বৃদ্ধ মৎস্যজীবীর দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এই গল্পের প্রধান চরিত্র সান্তিয়াগো, যিনি একজন বৃদ্ধ মৎস্যজীবী। বেশ কিছুদিন মাছ ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পরও, সান্তিয়াগো একটি বিশাল মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে পাড়ি জমান। সেই মাছকে ধরা এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্য তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সংগ্রাম এই উপন্যাসের মর্মকথা।

সাহসের প্রতীক সান্তিয়াগো

সান্তিয়াগোকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এমন একজন চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি তার জীবনের শেষ দিনগুলোতেও অদম্য মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জীবনের প্রতিকূলতা, ব্যর্থতা ও সমাজের অসম্মানের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো থেমে যান না। এমনকি তার শরীর দুর্বল এবং বার্ধক্যের ভারে ক্লান্ত হলেও, তার অন্তর্দৃষ্টির শক্তি প্রবল।

গল্পের শুরুতেই আমরা জানতে পারি যে, সান্তিয়াগো টানা ৮৪ দিন কোনো মাছ ধরতে পারেননি। এই লম্বা সময় ধরে ব্যর্থতার পরও, তিনি হাল ছাড়েননি। এই দুঃসময়ের মধ্যে তিনি ধৈর্য ধারণ করে অবিচল থাকেন এবং সমুদ্রের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেন।

“দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি”-এর কেন্দ্রীয় থিমগুলির মধ্যে সাহস ও দৃঢ়তা অন্যতম। সমুদ্রে যাওয়ার সময় সান্তিয়াগো জানতেন যে, তিনি হয়তো ফিরে আসবেন না, তবু তিনি তার লক্ষ্য পূরণের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নেন।

সান্তিয়াগোকে একটি প্রতীক হিসেবে দেখা যেতে পারে, যে প্রতিটি মানুষের জীবনযুদ্ধে একটি মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। জীবনের যেকোনো সমস্যা, বিপত্তি বা পরাজয় মানুষের সাহসিকতার পরীক্ষায় এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখছি, সান্তিয়াগোর সংগ্রাম শুধু মাছ ধরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার সংগ্রাম জীবনের সাথে, প্রকৃতির সাথে, এমনকি নিজের সঙ্গে।

সমুদ্র: প্রতীকী ও বাস্তব

এই উপন্যাসে সমুদ্র শুধুমাত্র একটি পটভূমি নয়, বরং এটি একটি জটিল প্রতীক। সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি চলাচল, প্রকৃতির পরিবর্তন, এবং তার গভীরতা জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে। সমুদ্রের বিশালতা যেমন আছড়ে পড়ে সান্তিয়াগোর জীবন ও সংগ্রামে, তেমনি তা পাঠকের মনে জন্ম দেয় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি ও গাম্ভীর্য।

সান্তিয়াগোর সঙ্গে সমুদ্রের সম্পর্ক এক ধরনের নীরব বোঝাপড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। সমুদ্র তার কাছে কখনো বন্ধু, কখনো শত্রু, আবার কখনো অনুপ্রেরণা। সান্তিয়াগো তার মনের গভীরে সমুদ্রকে শ্রদ্ধা করে, কারণ সমুদ্র তাকে প্রতিবারই নতুন কিছু শেখায় এবং তার সাহসিকতার পরীক্ষা নেয়।

এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্ভরতা ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই। সমুদ্র শুধুমাত্র তার রুটি-রুজির উৎস নয়, এটি তার চেতনার একটি অঙ্গ। সমুদ্রকে জয় করার চেষ্টা আর একই সঙ্গে সমুদ্রের বুকে ফিরে যাওয়ার এই অনন্ত চক্র জীবন ও মৃত্যুর প্রতীকও বটে।

মারলিন: এক বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বী

গল্পের কেন্দ্রীয় ঘটনা হলো সান্তিয়াগোর বিশাল মারলিন মাছ ধরার অভিযান। এ মাছটি শুধু তার শিকার নয়, বরং তার জীবনের একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। মারলিনের সাথে তার সংগ্রাম বাস্তবতার সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে এক ধরনের আত্মিক লড়াইয়ে পরিণত হয়।

সান্তিয়াগোর চোখে মারলিন শুধুমাত্র একটি শিকার নয়, বরং এক ধরণের সমান প্রতিদ্বন্দ্বী। সে জানে যে, এই মাছের শারীরিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ়তা তার নিজস্ব শক্তির মতোই প্রবল। মাছটিকে ধরা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা তার কাছে জীবনের এক মহান প্রতীকী অর্জন হয়ে ওঠে।

মারলিন মাছের সাথে তার সংগ্রামের মাধ্যমে হেমিংওয়ে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সীমার মধ্যে দণ্ডায়মান সাহসিকতাকে চিত্রিত করেছেন। যদিও সান্তিয়াগো মাছটিকে ধরতে সক্ষম হন, কিন্তু তার প্রকৃত বিজয় হলো সেই মাছটিকে ধরার জন্য যে ধৈর্য, কৌশল এবং সাহস প্রদর্শন করেছেন তা।

বার্ধক্য ও একাকীত্বের সংগ্রাম

এ উপন্যাসের আরেকটি গভীর এবং মূল থিম হলো বার্ধক্য ও একাকীত্ব। সান্তিয়াগো একজন বৃদ্ধ মৎস্যজীবী, যিনি তার জীবনযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার বার্ধক্য তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করেছে, কিন্তু তার মানসিক শক্তি এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে।

তার নিকটতম সঙ্গী, মাঞ্জোলিন, যিনি একজন তরুণ মৎস্যজীবী এবং সান্তিয়াগোর পূর্ব শিক্ষার্থী, পরিবারের চাপে সান্তিয়াগোর নৌকা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতা তাকে আরও একা করে তুলেছে।

বার্ধক্যের কারণে সান্তিয়াগোকে একাকীত্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু তিনি এই একাকীত্বকে এক ধরনের মমত্ববোধের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠেন। সমুদ্র, আকাশ, তারকারা—সবাই তার নীরব সঙ্গী।

গল্পে এমনকি তার একাকীত্ব কখনো কখনো তার আত্মজিজ্ঞাসার প্রতিফলন হয়ে ওঠে। সমুদ্রের বুকে একাকী নৌকায় বসে, সে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে, নিজের ব্যর্থতা এবং জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে। এইভাবে, সান্তিয়াগোর একাকীত্ব কেবল শারীরিক নয়, এটি একটি মানসিক ও আধ্যাত্মিক একাকীত্বের রূপ নেয়।

মানবতার অনন্ত সংগ্রাম

“দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি”-এর একটি মৌলিক ধারণা হলো জীবনের অনন্ত সংগ্রাম। সান্তিয়াগো একদিন মাছটি ধরতে সফল হন, কিন্তু তারপর সেই মাছকে হাঙরের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়। হাঙরের আক্রমণে মাছের শরীরের মাংস ছিঁড়ে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র মাছের কঙ্কালটিই বাকি থাকে।

এই কাহিনী জীবনের চক্রাকারে চলমান সংগ্রামের এক প্রতীক। মানুষের জীবনে যেমন কোনো কিছু অর্জন করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, ঠিক তেমনিভাবে সেই অর্জিত জিনিসটিকে ধরে রাখাও একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সান্তিয়াগো বুঝতে পারেন যে, প্রকৃতি তার মতোই শক্তিশালী এবং তাকে হার মানাতে পারে, কিন্তু সে কখনো মনোবল হারায় না।

তার সংগ্রামের ফলে কেবল একটি মাছের কঙ্কাল ফিরে পাওয়া হলেও, তার আত্মার শক্তি, সংগ্রামী মনোবল এবং সাহসিকতা তাকে এক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ধরনের সংগ্রামকে হেমিংওয়ে মানবতার মৌলিক সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ

হেমিংওয়ের এ উপন্যাসটিকে শুধুমাত্র একটি শিকারি গল্প হিসেবে দেখা হবে না। এটি এক ধরণের আধ্যাত্মিক ভ্রমণও বটে। সান্তিয়াগোর সমুদ্রযাত্রা এবং মাছ ধরার প্রচেষ্টা তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে এক ধরনের আত্ম-অন্বেষণের ইঙ্গিত দেয়।

উপন্যাসটির মধ্যে যেসব উপাদান রয়েছে, তা মূলত জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধ্যাত্মিক সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সান্তিয়াগোর লড়াই শুধু মাছ ধরার নয়, বরং এটি একধরনের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরীক্ষা। গল্পের শেষে, যখন সান্তিয়াগো বুঝতে পারেন যে, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার মনোবল এবং আত্মশক্তি কখনো ধ্বংস হবে না, তখন এটি এক ধরনের আত্মদর্শনের স্তরে পৌঁছে যায়।

ভাষা এবং শৈলী

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা সর্বদা সংক্ষিপ্ত, সরল এবং তীক্ষ্ণ। “দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি”-তেও এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তিনি এক ধরনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় অসাধারণ গভীরতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

হেমিংওয়ের সাহিত্যকর্মের একটি বিশেষ দিক হলো তার “আইসবার্গ থিওরি”। এই তত্ত্ব অনুসারে, লেখক কেবলমাত্র একটি ঘটনার বা বস্তুর উপরিভাগ তুলে ধরেন, কিন্তু তার নীচের গভীরতা এবং মর্মার্থ পাঠকের অনুধাবনের জন্য ফেলে রাখেন।

এই উপন্যাসেও আমরা দেখি, বর্ণনায় সরলতা থাকলেও তার নিচে রয়েছে একটি গভীর দর্শন। সান্তিয়াগোর প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি লড়াই, তার সঙ্গীদের প্রতি ভালোবাসা, সমুদ্রের প্রতি শ্রদ্ধা—সবকিছুই সরল ভাষার আড়ালে এক গভীর অর্থ বহন করে।

উপসংহার: এক মহান যাত্রার সমাপ্তি

“দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি” এক ধরনের মহাকাব্যিক সাহসিকতার কাহিনী। সান্তিয়াগোকে প্রতিটি পাঠক তার জীবনের সংগ্রামের সঙ্গে মেলাতে পারেন। এই উপন্যাস শুধুমাত্র এক বৃদ্ধের মাছ ধরার গল্প নয়, বরং এটি মানবজাতির সাহস, সংগ্রাম এবং জীবনের অর্থ খোঁজার প্রতীকী উপস্থাপনা।

সান্তিয়াগোর কাহিনী আমাদেরকে শেখায় যে, জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, হয়তো আমরা সবসময় বিজয়ী হব না, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম এবং সাহসই আমাদের প্রকৃত সাফল্যের পরিচয় বহন করে।

“দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি”-এর মাধ্যমে হেমিংওয়ে আমাদেরকে এই অনন্ত সত্যটি স্মরণ করিয়ে দেন: জীবন যেমনই হোক না কেন, আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই সাহসিকতা, সংকল্প এবং ধৈর্য দরকার।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মহিলা কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য, মানবিক অনুভূতি, প্রেম, বিরহ, এবং সমাজের বিভিন্ন দিকগুলো

Read More

মুহম্মদ আবদুল হাই এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ নভেম্বর ১৯১৯ – ৩ জুন ১৯৬৯) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক। তার গবেষণা এবং কর্ম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

Read More

ন্যায় দর্শনের বিষয়বস্তু: ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? ন্যায় দর্শন কী বা কাকে বলে? ন্যায় দর্শনের কয়টি শাখা ও কি কি?

ন্যায়দর্শন হচ্ছে ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম একটি দর্শন। ন্যায়দর্শন হল সেই ভিত্তি যার উপর ভারতের উচ্চতর দর্শনগুলি নির্মিত হয়েছে। ন্যায় দর্শনের প্রবক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি

Read More

বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৮ সালের কার্তিকে, ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায়। কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে। নজরুলের বিদ্রোহী

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.