অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭) বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নাম। কবি, গবেষক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে তার বিশিষ্টতা তাকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অনন্য স্থান দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে ১০ এপ্রিল ১৯০১ তারিখে জন্মগ্রহণ করা অমিয় চক্রবর্তীর সাহিত্যিক জীবন এবং কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যময় এবং প্রভাবশালী।
জীবন ও পরিবার
অমিয় চক্রবর্তীর পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন আসামের গৌরীপুর রাজ্যের দেওয়ান। তার মা অনিন্দিতা দেবী একজন সাহিত্যপ্রেমী এবং সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন, যিনি “বঙ্গনারী” ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতেন। তার শৈশবকাল গৌরীপুরে কাটলেও, পরে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। শিক্ষা জীবনে তার প্রাথমিক প্রভাব ছিল তার মামাদের, বিশেষ করে বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র এবং সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের।
পরে, হাজারিবাগের সেন্ট কলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করে, তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গবেষণার জন্য যান এবং ১৯৩৭ সালে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্ক
অমিয় চক্রবর্তীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো তার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্ক। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন গ্রন্থ ও তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করতেন। এই সম্পর্ক তাকে সাহিত্যিকভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তার পরবর্তী কাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক পরিচিতি
অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন একজন বিশ্বনাগরিক। তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৯৩০ সালে তার প্রথম বিদেশ সফর শুরু হয় বার্মিংহামে। পরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। তিনি আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি, কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।
সাহিত্যকর্ম
অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব থাকলেও, তিনি অচিরেই তার স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতাবলী’ এবং ‘উপহার’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘খসড়া’, যা তার সাহিত্যিক পরিচিতি আরও দৃঢ় করে।
অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো তার গভীর দর্শন ও বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা। তার কবিতায় অনুভূতির সূক্ষ্ম রহস্য এবং বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ রয়েছে। তিনি মানবিক অনুভূতি এবং মননশীলতা মিশিয়ে কবিতায় প্রগাঢ় দার্শনিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কবিতা
অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা স্বকীয়তার জন্য সুপরিচিত। তার কবিতায় গভীর মননশীলতা এবং সময় ও সমাজ সচেতনতা প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তার একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েকোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।
সঙ্গীত
অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গীতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তার শৈশব কেটেছে গৌরীপুরে, যেখানে যাত্রা-নাটক এবং বাউল-কীর্তণ ছিল নিয়মিত বিষয়। কলকাতার মামা বাড়িতে এসে তিনি ইউরোপীয় সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন। এই সঙ্গীতের প্রতি তার আগ্রহ এবং প্রতিভা তার সাহিত্যকর্মে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
অমিয় চক্রবর্তী তার সাহিত্যিক কাজের জন্য নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি পদ্মভূষণ, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কারসহ অনেক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তার সাহিত্যিক অবদান এবং শিক্ষাগত কাজ তাকে বাংলা সাহিত্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে অমর করেছে।
মৃত্যু
অমিয় চক্রবর্তী ১৯৮৬ সালের ১২ জুন শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিরাট শূন্যতা তৈরি করেছে।
অমিয় চক্রবর্তীর জীবন ও সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার সমন্বয়। তার কবিতা, গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতি তাকে একটি অমর সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।