১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সত্যানন্দ দাশ এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী ছিলেন তাঁর পরিবারের মূল স্তম্ভ। সত্যানন্দ দাশ একজন স্কুল শিক্ষক, প্রবন্ধকার এবং সমাজ সেবক ছিলেন। তিনি ‘ব্রহ্মবাদী’ নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। কুসুমকুমারী দেবী একজন গুণী কবি ছিলেন এবং তাঁর কবিতার মধ্যে গভীর ভাবনা ও মাধুর্য ছিল। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরাপালক” এর পরে প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থে তাঁর মায়ের প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়।
শিক্ষাজীবন
জীবনানন্দের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে। এখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর, তিনি ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে আইনশাস্ত্রের পাঠ শেষ করেন। তাঁর শিক্ষাগত জীবনে একাধারে সাহিত্য, সমাজ ও ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ ছিল যা পরবর্তীতে তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
কর্মজীবন
১৯২২ সালে কলকাতার সিটি কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন জীবনানন্দ। পরবর্তীতে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, যেমন খুলনা রাজারহাট কলেজ, দিল্লির রামযস কলেজ এবং বরিশালের বি এম কলেজ। দেশভাগের সময় কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। তাঁর কর্মজীবন অনেকটাই অসংগঠিত ছিল, যা তাঁর সাহিত্যিক কাজের উপর প্রভাব ফেলেছিল।
দাম্পত্য জীবন
১৯৩০ সালের মে মাসে ঢাকার লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে জীবনানন্দের বিবাহ হয়। তাঁদের কন্যা মঞ্জুশ্রী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে। তবে দাম্পত্য জীবন তাঁর সুখকর ছিল না এবং বহুদিন কর্মহীন জীবন কাটাতে হয়েছে।
সাহিত্যকর্ম
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ও পরবর্তী প্রকাশনা
জীবনানন্দের সাহিত্যকর্মের সূচনা হয় ১৯১৯ সালে যখন তাঁর প্রথম কবিতা “বর্ষ আবাহন” প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরাপালক।” এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:
- “ধূসর পান্ডুলিপি” (১৯৩৬)
- “বনলতা সেন” (১৯৪২)
- “মহাপৃথিবী” (১৯৪৪)
- “সাতটি তারার তিমির” (১৯৪৮)
- “রূপসী বাংলা” (১৯৫৭)
- “বেলা অবেলা কালবেলা” (১৯৬১)
এই কবিতাগুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানব জীবনের বিপন্নতা এবং দার্শনিক ভাবনাগুলিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
উপন্যাস ও ছোটগল্প
জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতায় নয়, উপন্যাস ও ছোটগল্পেও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস “মাল্যবান ও সুতীর্থ” এবং তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় ১২৬টি। যদিও জীবদ্দশায় তিনি খুব কম লেখার প্রকাশিত করতে পেরেছেন, মৃত্যুর পরে তাঁর অনেক অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবনকালে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৫২ সালে রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৫৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যুর পর
১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় একটি ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি অন্যমনস্ক অবস্থায় ছিলেন এবং ট্রামের আওয়াজও শুনতে পাননি। মৃত্যুর পর তাঁর সাহিত্যকর্মে নতুনভাবে মূল্যায়ন শুরু হয় এবং তাঁর কবিতা বাংলা সাহিত্যজগতের অমূল্য রত্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেষকথা
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কাল সচেতন ও ইতিহাস সচেতন কবি। তাঁর কবিতায় আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এক অনন্য অবস্থান রয়েছে। তাঁর কাব্যিক ভাষা, উপমা এবং চিত্রকল্প বাংলা সাহিত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক অমলিন চিহ্ন রেখে গেছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জগৎ এবং তাঁর কবিতার গভীরতা আমাদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর কাজ আমাদের মনে করে দেয় যে, সাহিত্য শুধুমাত্র শব্দের খেলা নয়, এটি একটি গভীর অনুভূতির অভিব্যক্তি যা মানুষের হৃদয় ও আত্মাকে স্পর্শ করে।