বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা গ্রামীণ জীবন, লোকায়ত সংস্কৃতি এবং বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে শিল্পময়ভাবে তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। তিনি তাঁর কাব্য এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বাংলার পল্লীজীবনকে কাব্যিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং তার সাহিত্যিক স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, আত্মজীবনী এবং ভ্রমণকাহিনী।
জীবনী
জসীম উদ্দীন মোল্লা ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুরের গোবিন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা এবং মাতা আমিনা খাতুন। পিতা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁর পরিবারের মধ্যে জসীম উদ্দীন ছিলেন চতুর্থ সন্তান।
জসীম উদ্দীন প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন ফরিদপুর জেলা স্কুলে, তারপর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি এবং বি.এ পাশ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৪৩ সালে তিনি মহসীন উদ্দীনের মেয়ে মমতাজকে বিবাহ করেন।
সাহিত্যকর্ম
জসীম উদ্দীনের সাহিত্যকর্মের মধ্যে কবিতা, কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, আত্মজীবনী এবং ভ্রমণকাহিনী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল ‘মিলন গান’, যা ১৯২১ সালে মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’ ১৯২৫ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তিনি ১৯২৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশ করেন। ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে ‘রাখালী’, ‘কিশোরী’, ‘রাখাল ছেলে’, ‘কবর’, ‘পল্লীজননী’, ‘পাহাড়িয়া’, ‘গহীন গাঙের নাইয়া’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাহিনি কাব্য তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম। এই কাব্যগ্রন্থে দুটি গ্রামের তরুণ-তরুণীর প্রেম এবং তাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। কাব্যটির ভূমিকা ও প্রচ্ছদ অঙ্কন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৩০ সালে তাঁর ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১৭টি কবিতা রয়েছে এবং কাব্যটি ত্রিপদী ছন্দে রচিত।
এরপর তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪), ‘হাসু’ (১৯৩৮), ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ (১৯৩৫), ‘রূপবতি’ (১৯৪৬), ‘মাটির কান্না’ (১৯৫১), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৫৩), ‘সকিনা’ (১৯৫৯), ‘সুচয়নী’ (১৯৬১), ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩), ‘কাফনের মিছিল’ (১৯৮৮) প্রভৃতি।
জসীম উদ্দীনের নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পদ্মাপাড়’ (১৯৫০), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৫১), ‘মধুমালা’ (১৯৫১), ‘পল্লীবধূ’ (১৯৫৬), ‘গ্রামের মেয়ে’ (১৯৫৯), এবং ‘আসমান সিংহ’ প্রভৃতি।
তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনার মধ্যে রয়েছে ‘যাদের দেখেছি’ এবং ‘ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়’। এছাড়া তাঁর ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে রয়েছে ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরীর দেশ’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’, এবং ‘জার্মানির শহরে বন্দরে’।
‘বোবা কাহিনী’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় যা তাঁর একমাত্র উপন্যাস। এই উপন্যাসে ভূমিহীন কৃষকদের দুঃখ, মহাজনের শোষণ, এবং সমাজের ভণ্ড ধার্মিকদের কথা উঠে এসেছে।
সাহিত্য পুরস্কার
জসীম উদ্দীন জীবদ্দশায় নানা সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬৪ সালে তাঁকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন এবং ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) অর্জন করেন।
সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য
জসীম উদ্দীনের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পল্লী জীবনের অতি বাস্তব এবং প্রাকৃতিক চিত্রণ। তাঁর কবিতার মধ্যে গ্রামীণ সংস্কৃতি, মানুষের জীবনযাপন, শ্রমের কষ্ট এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘কবর’, ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, এবং ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থগুলোতে গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন দিককে অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাষা ও ভাবকে ‘নতুন ধরনের’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেন, জসীম উদ্দীনের কবিতা বাংলার পল্লী জীবনকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে এবং তা এক নতুন রূপে প্রকাশ পেয়েছে।
নকশী কাঁথার মাঠ
‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাহিনি কাব্যটি বাংলার গ্রামীণ জীবন এবং সংস্কৃতির একটি অপরূপ চিত্র তুলে ধরেছে। কাব্যটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপাই ও সাজু, যাদের প্রেম, বিবাহ এবং পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন টানাপোড়েনের গল্প এটি। কাব্যটি বাংলার পল্লী জীবন, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক জীবন্ত চিত্র উপস্থাপন করেছে।
চিহ্নিত শিল্পী
জসীম উদ্দীন তাঁর কাব্যিক কর্মের মাধ্যমে শুধু পল্লী কবি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেননি, বরং বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর সাহিত্য কেবলমাত্র পল্লী জীবনকে চিত্রিত করেনি, বরং তাঁর কাব্যিক রীতি, ভাষা, এবং ভাবনা বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
জসীম উদ্দীন ১৩ মার্চ ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী ফরিদপুরের অম্বিকাপুর গ্রামে তাঁর দাদির কবরের পাশে সমাহিত হন। তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য রত্ন হিসেবে স্বীকৃত এবং পাঠক সমাজে তাঁর কাব্যিক দক্ষতা ও সাহিত্যিক প্রতিভার জন্য তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।