সৈয়দ ফররুখ আহমদ (জুন ১০, ১৯১৮ – অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিক, যিনি বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাঁর জন্ম মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে, যেটি তখন যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। তিনি সৈয়দ বংশের একজন সদস্য। তাঁর পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং মাতা রওশন আখতার। ফররুখ আহমদ এর পরিবারে, তার চারটি ছেলে এবং সাতটি মেয়ে ছিল।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে বিয়ে করেন। বিয়ের প্রাক্কালে তিনি ‘উপহার’ নামক একটি কবিতা লেখেন, যা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
শিক্ষাজীবন
ফররুখ আহমদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় খুলনা জিলা স্কুলে। তিনি ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তিত হয় এবং পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানান।
কর্মজীবন
ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে ১৯৪৮ সালে দেশ বিভাগের পর, তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বেতারে যোগদান করেন। তিনি ঢাকায় প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
রচনাশৈলী
ফররুখ আহমদের কবিতার রচনাশৈলী অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। তিনি সনেটের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর কবিতায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দৃশ্যমান, এবং আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল, তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি একবার লিখেছিলেন, “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
কাব্যগ্রন্থ ও পুরস্কার
ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
- সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪)
- নতুন কবিতা (১৯৫০)
- সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২)
- নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১) – কাব্যনাট্য
- মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩)
- ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩)
- হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬) – কাহিনীকাব্য
- নতুন লেখা (১৯৬৯)
- কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০)
- হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১)
- সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩)
- দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)
শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো:
- পাখির বাসা (১৯৬৫)
- হরফের ছড়া (১৯৭০)
- চাঁদের আসর (১৯৭০)
- ছড়ার আসর (১৯৭০)
- ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)
ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬৫), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬), এবং ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬) প্রাপ্ত হন। মৃত্যুর পর, ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।
মৃত্যু
ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। অর্থনৈতিক সংকট ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অনেক কষ্ট ভোগ করেন। তাঁর একটি মেয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় এবং অন্য একটি ছেলে অর্থের অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। রমজান মাসে, টাকা না থাকার কারণে তিনি খেতে না পেয়ে রোজা রেখেছিলেন। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দাফনের বিষয়ে সমস্যা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত কবি বেনজীর আহমদ তাঁর শাহজাহানপুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করার ব্যবস্থা করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক আসাফউদ্দৌলা রেজাসহ অনেকে সরকারিভাবে একটি কবরস্থান পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি।
ফররুখ আহমদ তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মাধ্যমে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজের নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরে, তিনি বাংলা সাহিত্যকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। তাঁর অমর সৃষ্টি এবং কবিতার গভীরতা যুগ যুগ ধরে পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করবে এবং প্রেরণা জোগাবে।