- জন্ম ও পরিবারের পরিচিতি:
- জন্ম: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে।
- পরিবার: সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্ম। পিতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী।
- পূর্বপুরুষ: মুগল আমলে উচ্চ সামরিক ও বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োজিত ছিলেন।
- শিক্ষা ও প্রাথমিক জীবন:
- বাল্যশিক্ষা: পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের সময় কিছুদিন মেম শিক্ষয়িত্রীর নিকট লেখাপড়া করেন। কিন্তু সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
- ভাই-বোনদের প্রভাব: বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন এবং ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হন। বড় বোন করিমুন্নেসার সহায়তায় রোকেয়া বাড়িতে পড়াশোনা করেন।
- বিয়ে ও পারিবারিক জীবন:
- বিয়ের পর নাম: ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বিবাহ হয়। বিয়ের পরে তাঁর নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
- স্বামীর প্রভাব: স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন প্রগতিশীল, কুসংস্কারমুক্ত এবং সমাজসচেতন। তাঁর সহায়তায় রোকেয়া ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং সাহিত্যে আগ্রহী হন।
- ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও সমাজসেবা:
- স্বামীর মৃত্যুর পর: ১৯০৯ সালের ৩ মে স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। তাঁদের দুটি কন্যাসন্তানও অকাল মৃত্যুবরণ করে।
- নারীশিক্ষা ও সমাজসেবা: স্বামীর মৃত্যুর পর, রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
- সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল:
- প্রতিষ্ঠা: ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন।
- কলকাতায় স্থানান্তর: পারিবারিক কারণে ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের বাড়িতে নতুন করে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- স্কুলের উন্নয়ন: ১৯১৭ সালে স্কুলটি মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুলে এবং ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়। স্কুলের বিভিন্ন সময়ের অবস্থান ছিল ইউরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন (১৯১৩), লোয়ার সার্কুলার রোড (১৯৩২), লর্ড সিনহা রোড (১৯৩৮) এবং আলীপুর হেস্টিংস হাউস (১৯৩৮)।
- নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার:
- শিক্ষা ও কর্মসূচি: সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে কুরআন পাঠ, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চা, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হত।
- পুনর্গঠন ও সংগ্রাম: স্কুল পরিচালনা ও পাঠদানে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন বালিকা স্কুল পরিদর্শন করতেন।
- সরকারি সাহায্য ও সামাজিক বিরোধ:
- মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল: ১৯১৯ সালে সরকার কলকাতায় ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’ স্থাপন করে। সরকারি সাহায্য ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল কঠিন।
- সাহিত্যকর্ম:
- প্রথম লেখা: ১৯০৩ সালে নবনূর পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। তবে মতান্তরে, প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয় নবপ্রভা পত্রিকায়।
- প্রকাশিত রচনা: সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, The Mussalman, Indian Ladies Magazine প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।
- উল্লেখযোগ্য রচনা:
- মতিচূর (প্রবন্ধ, ২ খন্ড): প্রথম খন্ড ১৯০৪, দ্বিতীয় খন্ড ১৯২২।
- Sultana’s Dream (নকশাধর্মী রচনা, ১৯০৮): বাংলায় অনুবাদ করেছেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে।
- পদ্মরাগ (উপন্যাস, ১৯২৪)
- অবরোধবাসিনী (নকশাধর্মী গদ্যগ্রন্থ, ১৯৩১)
- সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য:
- লেখার শৈলী: ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও শেষাত্মক রচনায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা, এবং কৌতুকপ্রিয়তা তাঁর লেখার সহজাত বৈশিষ্ট্য।
- বিজ্ঞান ও সাহিত্য: বিজ্ঞান সম্পর্কেও অনুসন্ধিৎসা ছিল।
- সমর্থন ও সহযোগিতা:
- সওগাত পত্রিকা: সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁকে উৎসাহিত করেন। প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ‘সওগাত’ কবিতা প্রকাশিত হয়।
- বিভিন্ন লেখক ও প্রকাশক: তাঁর সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন এবং সমর্থন প্রদান করেন।
- নারী আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তন:
- আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম: ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম মহিলা সমিতি।
- সমাজিক সেবামূলক কাজ: বিধবা নারীকে অর্থ সাহায্য, দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা, অসহায় অনাথ শিশুকে আশ্রয় প্রদান প্রভৃতি কাজ করেছেন।
- মৃত্যু ও Legacy:
- মৃত্যু: ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ।
- অবদান: বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে রোকেয়ার অবদান চিরঅম্লান। তাঁর শিক্ষা, সাহিত্য, ও সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন।
- সাহিত্য ও সামাজিক অবদান:
- সামাজিক পরিবর্তন: সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে নারীর শিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
- বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম: বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ছিল।
- গ্রন্থ প্রকাশ ও পরবর্তী প্রভাব:
- গ্রন্থ প্রকাশ: মতিচূর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানাস ড্রিম প্রভৃতি বই প্রকাশিত হয়েছে।
- পরবর্তী প্রভাব: বাঙালি মুসলমান সমাজের নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত হিসেবে তাঁর জীবন ও কাজ পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর অবদান এবং সংগ্রাম বর্তমান সময়েও আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায় এবং সমাজ সংস্কারে প্রেরণা প্রদান করে।