কাজী নজরুল ইসলাম: বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি শুধু কবি নন, বরং বিদ্রোহ, সাম্য, প্রেম, বিরহ, দ্রোহ, এবং মানবতার কবি। তবে, বিশ্বজুড়ে তিনি বিশেষভাবে বিদ্রোহী কবি হিসেবে প্রশংসিত। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে বিশাল সাগরের মধ্যে একটি টর্নেডোর সাথে তুলনা করা হয়, কারণ তাঁর সৃজনশীলতা ও শক্তি বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক নতুন আলো ছড়িয়েছে।
তিনি বাংলা সাহিত্যে “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;” নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। একদিকে তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী উন্মাদনা দেখা যায়, অপরদিকে প্রেমের স্নিগ্ধতা ও মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন তিনি আমৃত্যু।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন সাহিত্যিক, কবি, উপন্যাসিক, সঙ্গীতজ্ঞ, গীতকার, সুরকার, নাট্যকার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সম্পাদক, এবং সৈনিক। তিনি অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সদা সচেতন ছিলেন। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভার জন্যই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়ের নাম বলা হয়।
এই আর্টিকেলে কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চলুন, বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু
জন্ম: কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, বাংলার ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চারুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মৃত্যু: কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, বাংলার ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে পরলোকগমন করেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি
নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা ২২ অক্টোবর ১৯২২ তারিখে ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই প্রমথ চৌধুরী তাঁকে “বিদ্রোহী কবি” উপাধি দেন।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চারুলিয়া গ্রামের একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বপুরুষেরা মোগল সম্রাজ্যের বিচারলয়ে কাজী ছিলেন এবং সেই থেকে কাজী পদবী বংশানুক্রমে চলে এসেছে। তবে, পরবর্তীতে তাঁদের অবস্থার অবনতি হয়। নজরুলের পিতামহ ও বাবা মাজার শরীফ ও মসজিদের ইমাম ছিলেন।
নজরুল ইসলামের নাম “দুখু মিয়া” কেন? জন্মের আগে তাঁর বড় তিন ভাই মারা যান। এ কারণে জন্মের পর তাঁর দাদী তাঁকে “দুখু মিয়া” নাম রাখেন। কিন্তু, এই দুখু মিয়া একদিন মহা প্রতিভাবান কবি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হন।
কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষা জীবন
নজরুল ইসলাম তাঁর বাল্যকালে নিকটস্থ মক্তব থেকে শিক্ষা শুরু করেন, যেখানে বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাঁর পড়াশোনা থেমে যায়। মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকার সন্ধানে কাজ করতে শুরু করেন। মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি শিক্ষকতা ও লেটো দলের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। লেটো দলের নানা পালা গান ও গজল পরিবেশন করতে করতে তাঁর প্রতিভা প্রকাশ পেতে শুরু করে।
কাজী নজরুল ইসলামের বিবাহ
নজরুল ইসলাম দুটি বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরের নার্গিস আনম খানকে হলেও পরদিনই তিনি ছেড়ে চলে যান। দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৯২৪ সালে গিরিবালা সেন গুপ্তের মেয়ে প্রমিলা সেন গুপ্তকে।
কাজী নজরুল ইসলামের সেনাবাহিনীতে যোগদান
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কাজী নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ৪৯ নাম্বার বাঙালি পল্টন রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে পদন্নতি লাভ করেন। করাচিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি কবিতা ও সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম নিজ মাতৃভূমি চারুলিয়ায় ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় যেমন—মুসলিম ভারত, মসিক প্রবাসি, বিজলী, ধূমকেতু ইত্যাদিতে তাঁর সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হন।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ
১. অগ্নিবীণা (১৯২২) 2. দোলন-চাঁপা (১৯২৩) 3. বিষের বাঁশি (১৯২৪) 4. ভাঙ্গার গান (১৯২৪) 5. সাম্যবাদী (১৯২৫) 6. চিত্তনামা (১৯২৫) 7. ছায়ানট (১৯২৫) 8. ঝিঙে ফুল (১৯২৬) 9. পুবের হাওয়া (১৯২৬) 10. সর্বহারা (১৯২৬) 11. ফণী-মনসা (১৯২৭) 12. সঞ্চিতা (১৯২৮) 13. জিঞ্জীর (১৯২৮) 14. হিন্দু সিন্দোল (১৯২৮) 15. চক্রবাক (১৯২৯) 16. সন্ধ্যা (১৯২৯) 17. প্রলয় শিখা (১৯৩০) 18. নির্ঝর (১৯৩৯) 19. নতুন চাঁদ চৈত্র (১৯৪৫) 20. মরুভাস্কর (১৯৫১) 21. সঞ্চয়ন (১৯৫৫) 22. ঝড় (১৯৬১)
কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস
১. বাঁধনহারা (১৯২৭) 2. মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) 3. কুহেলিকা (১৯৩১)
কাজী নজরুল ইসলামের নাটক
১. আলোয়া (১৯৩১) 2. ঝিলিমিলি (১৯৩০) 3. মধুমালা (১৯৫৯) 4. পতুলের বিয়ে (১৯৩৩, কিশোর নাটক) 5. মধুমালা (১৯৬০, গীতিনাট্য) 6. ঝড় (১৯৬০, কিশোর কাব্য নাটক) 7. পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (১৯৬৪, কিশোর-কাব্য-নাটক)
কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ
১. যুগবাণী (১৯২২) 2. ঝিঙে ফুল (১৯২৬) 3. দূর্দিনের যাত্রী (১৯২৬) 4. রুদ্র মঙ্গল (১৯২৭) 5. ধূমকেতু (১৯৬১) 6. রাজবন্ধির জবানবন্দি
এভাবে, কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা, ও সমাজ পরিবর্তনের বার্তা সংযোজিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য ধন।