Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

মীর মশাররফ হোসেন এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মীর মশাররফ হোসেন, বঙ্কিমযুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তার সৃষ্টিশীলতা ও গভীর মননশীলতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে এবং বাংলার সংস্কৃতি ও ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর। তাঁর পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো তার সন্তান মশাররফের জীবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তার পিতার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে। মশাররফ হোসেনের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পরিবারের অভ্যন্তরে মুনশির নিকট আরবি ও ফারসি শেখার মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি কুষ্টিয়া স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা ঘটে। এরপর কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন। তবে লেখাপড়ায় তাঁর অগ্রগতি সীমিত ছিল এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি।

শিক্ষা জীবনের পর, মীর মশাররফ হোসেন তার পিতার জমিদারি দেখাশোনা শুরু করেন। তবে তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি করে। ১৮৮৫ সালে তিনি দেলদুয়ার এস্টেটের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। এক সময় চাকরি ছেড়ে তিনি লাহিনীপাড়ায় ফিরে আসেন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় সংবাদ প্রেরণ করেন। কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে তার হৃদ্যতার কারণে তাঁকে কাঙাল হরিনাথের সাহিত্যশিষ্য বলা হয়।

সাহিত্যিক জীবন ও কর্ম

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় পত্রিকা সম্পাদনা এবং সংবাদ লেখার মাধ্যমে। ১৮৯০ সালে তিনি ‘হিতকরী’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বিষাদ সিন্ধু’, যা কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে।

এর পর, মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যিক কর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের চার বছর পর প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘রত্নবতী’। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সাহিত্যিক কর্মের মধ্যে ‘গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী সেতু’, ‘বসন্তকুমারী নাটক’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘এর উপায় কি’, ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘সংগীত লহরী’, ‘গো-জীবন’, ‘বেহুলা গীতাভিনয়’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, ‘তহমিনা’, ‘টালা অভিনয়’, ‘নিয়তি কি অবনতি’, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’, ‘মৌলুদ শরীফ’, ‘মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা’, ‘বিবি খোদেজার বিবাহ’, ‘মদিনার গৌরব’, ‘বাজীমাৎ’, ‘আমার জীবনী’, ‘আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত। নাটক ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলিতে তিনি সমকালীন সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষ্ণ কটাক্ষপাত করেছেন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুক্ত ছিলেন এবং উদার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধ লিখে তিনি নিজের সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হন।

সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও ধর্মীয় সমন্বয়

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যকর্মের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তার সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও ধর্মীয় সমন্বয়ের প্রতি অবদান। তার রচনায়, তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও বিচার সাম্যের একটি দুর্লভ পরিচয় প্রদান করেছেন। তার সাহিত্য রচনা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও সংঘর্ষ দূরীকরণে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছে।

তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আদর্শ তুলে ধরেন এবং তাঁর গ্রন্থ ‘গাজী মিয়া’ ছদ্মনামে রচিত রসরচনা ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ এই ঐক্যের এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর এই রচনাগুলি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা বহন করেছে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ

১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত তার লেখা প্রবন্ধ ‘গো-জীবন’ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন। এই প্রবন্ধে তিনি গোরু কোরবানির প্রথা সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করেন এবং একে বিকল্প কুরবানির পন্থা হিসেবে বিবেচনা করেন। এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয় এবং তাঁকে ধর্মীয়ভাবে নিন্দিত করা হয়। তিনি ধর্মসভায় কাফের হিসেবে ঘোষিত হন এবং তাঁর স্ত্রীর ওপরও হারাম প্রয়োগ করা হয়। যদিও মশাররফ হোসেন প্রথমে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন, পরে আপস মিটিয়ে নেন এবং প্রবন্ধটি পরবর্তীকালে আর প্রকাশিত হয়নি।

বিবাহ ও মৃত্যু

মীর মশাররফ হোসেন মাত্র আঠার বছর বয়সে তাঁর পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সঙ্গে বিবাহ করেন। বিবাহিত জীবনে, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বিবি কুলসুমও তার সাহিত্য কর্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। ১৯১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর, রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন মীর মশাররফ হোসেন। তাঁকে তাঁর স্ত্রীর কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়।

সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক অবদান

মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যিক অবদান শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং মুসলিম সংস্কৃতির উন্নতির ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। তিনি বাংলার মুসলমান সমাজকে আধুনিক ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং আরবি-ফারসি মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানী বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন।

তার স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮ সালে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়, যা দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে ছাত্রদের জন্য তৈরীকৃত দ্বিতীয় বৃহৎ আবাসিক হল। এই হল তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে এবং এটি তার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদানের প্রতি একটি সম্মানসূচক স্মারক।

উপসংহার

মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম, তার সৃষ্টিশীলতা, এবং তার সমকালীন সমাজের প্রতি গভীর মনোযোগের কারণে তিনি আজও বাঙালি পাঠকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর সাহিত্যিক অবদান বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ হিসেবে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তার লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘রত্নবতী’, ও ‘গাজী মিয়া’ ছদ্মনামে রচিত রসরচনা শুধু সাহিত্যেই নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও এক অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে।

মীর মশাররফ হোসেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম আজও বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটি প্রেরণার উৎস হিসেবে অমর থাকবে এবং বাংলার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

কাজী ইমদাদুল হক এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

কাজী ইমদাদুল হক (৪ নভেম্বর ১৮৮২ – ২০ মার্চ ১৯২৬) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, এবং সমাজকর্মী। তার সাহিত্যকর্ম এবং শিক্ষাবিষয়ক অবদানের

Read More

কাজী মোতাহার হোসেন এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই, ১৮৯৭ – ৯ অক্টোবর, ১৯৮১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা

Read More

ধ্বনিবিজ্ঞান কী বা ধ্বনিবিজ্ঞান কাকে বলে? ধ্বনিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও!

ধ্বনিবিজ্ঞান: ধ্বনিবিজ্ঞান হচ্ছে বাক্ ধ্বনির বিশ্লেষণ। বাগ্‌ধ্বনি সম্পর্কে পঠন-পাঠনকে বলা হয় ‘ধ্বনিবিজ্ঞান’। The science, study, analysis and classification of sounds, including the study of their

Read More

ধ্বনিবিজ্ঞান কী? ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বের পারস্পারিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর!

ধ্বনিবিজ্ঞান হচ্ছে বাক ধ্বনির বিশ্লেষণ। The science, study, analysis and classification of sounds, including the study of their production, transmission and perception. অপরদিকে ধ্বনিতত্ত্ব হলো

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.