দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০–১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের এক মহান নাট্যকার যিনি সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে নাট্যসাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র এবং জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ। ছাত্রজীবনে মেধাবী থাকা সত্ত্বেও পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের পাঠশালায় অর্জন করেন এবং পরে কলকাতায় আসেন উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
কলকাতায় আসার পর, দীনবন্ধু মিত্র খুল্লতাত গৃহে কাজ করে লেখা পড়ার খরচ চালান এবং পরে জেমস লঙের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৫০ সালে কাটুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমানে হেয়ার স্কুল) থেকে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। তিনি কলেজের উচ্চতর পরীক্ষায়ও বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৫৩ সালে টিচার শিপ পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করেন।
দীনবন্ধু মিত্র ভারতীয় ডাক বিভাগের চাকরি গ্রহণ করেন এবং নানা পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি কৃষ্ণনগর, নদীয়া, উড়িষ্যা এবং ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ১৮৭০ সালে কলকাতার শ্রীরামপুরে সুপারিন্টেণ্ড পোস্টমাষ্টার পদে আসীন হন। তার কর্ম জীবনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে।
পারিবারিক জীবন
দীনবন্ধু মিত্রের পারিবারিক জীবন সুখময় ছিল। তাঁর সাত পুত্র ও এক কন্যা ছিল। তবে তাঁর পারিবারিক জীবন নিয়ে বিশদ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সাহিত্য জীবন
দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার এবং কমেডি লেখক হিসেবে পরিচিত। তাঁর সাহিত্য জীবনের উল্লেখযোগ্য কাজ হলো:
- নীলদর্পণ (১৮৬০): এই নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নাটকটির মাধ্যমে দীনবন্ধু মিত্র ইংরেজ শাসকদের নীলচাষের মাধ্যমে কৃষকদের প্রতি অত্যাচারকে চিত্রিত করেছেন। এই নাটকটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দীনবন্ধু মিত্র নাটকটি প্রকাশের সময় ছদ্মনামে আত্মগোপন করেছিলেন, কারণ ইংরেজরা নাটকটি প্রসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
- নবীন তপস্বিনী (১৮৬০): এই নাটকে প্রহসনধর্মী কাহিনি রচিত হয়েছে, যেখানে কৌতুক ও সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
- কমলে কামিনী (১৮৭৩): একটি কমেডি নাটক যা প্রেম ও সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে।
- বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬): বিবাহ বাতিকগ্রস্ত বৃদ্ধের কৌতুকময় কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
- জামাই বারিক (১৮৭২): ধনী ঘরের শ্বশুরবাড়িতে ঘর জামাই পোষে রাখার প্রথার হাস্যরসাত্মক বর্ণনা।
- লীলাবতী (১৮৬৭): এই নাটকটি নায়ক-নায়িকার প্রেমের কাহিনি নিয়ে রচিত, যেখানে কৌতুকময় চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
- সধবার একাদশী (১৮৬৬): সমাজের দোষত্রুটি এবং যুব সম্প্রদায়ের চরিত্রহীনতা নিয়ে রচিত একটি প্রহসন নাটক।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যস্বভাব
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যস্বভাব সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বাস্তববাদী এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে নাটক রচনা করতেন। যদিও কিছু ক্ষেত্রে তাঁর নাটক অপ্রাকৃত এবং নিষ্প্রাণ মনে হতে পারে, তবুও তাঁর নাটকগুলির মধ্যে চরিত্র চিত্রণ এবং কৌতুক রসের জন্য তাঁকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। তাঁর “নীলদর্পণ” এবং “সধবার একাদশী” আজও বাংলা নাট্যসাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্যকর্ম বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। তাঁর নাটকগুলো সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।