পঞ্চপান্ডব কবি কারা: বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ অসংখ্য ক্ষণজন্মা লেখকের অবদানের ফলে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এই ক্ষণজন্মা লেখকদের মধ্যে ‘পঞ্চপান্ডব’ অন্যতম। তাঁরা বাংলা কবিতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছে। তাঁরা বাংলা কবিতায় জীবনের দুঃখ দুর্দশার মাঝে, আশা-নৈরাশ্যের মাঝে সংগ্রামী আহ্বানে জীবনের ধ্বনি জাগিয়ে তোলেছে। তাঁরা কবিতায় গীতি মূৰ্ছনার চেয়ে প্রচলিত জীবন ও বাস্তবতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। তাঁরা কবিতায় নিয়ে এসেছে নতুন সুর, নতুন মাত্রা। নিম্নে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ দের পরিচয় ও বাংলা কবিতায় তাদের অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :
পঞ্চপাণ্ডবের পরিচয় : আধুনিক কবি বলে আমরা যাদের দেখি তাঁরা ছিলেন মহান ৫ জন। বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী। এই ৫ জনকে একত্রে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বলা হয়।
সাধারণ আলোচনা : কবিতা সম্পর্কে বিভিন্নজনের ধারণা বিভিন্ন রকম, বোধের পার্থক্যও রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে, জাগতিক বৈচিত্র্যে, বাস্তবতা ও পরিবেশের অবস্থান্তরে মানুষের চিন্তা-চেতনা মোড় নেয়, অভিজ্ঞতা বদলায়। সুন্দর সম্পর্কে যেমন চূড়ান্ত বা স্পষ্ট কোনো কথা বলা সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় কবিতা সম্পর্কে চূড়ান্ত বা স্পষ্ট কোনো বাক্য দান। বিশেষত আধুনিক কবিতা এখন আর স্বপ্নাদিষ্ট রচনা নয়, রাজতোষণ, রাজা কিংবা দেবতার পূজ্য ফুল নয়, বিহঙ্গের ভাবপ্রবণ আকাশচারিতা নয়, গীতচ্ছন্দে গান গাওয়া নয়, নয় আবেগের রোমাঞ্চকর উচ্ছ্বাস। কিন্তু এখনও অনেকেই কবিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করতে অনিচ্ছুক। কবিতা বলতে অনেকেই সেই আগেকার গীতচ্ছন্দ বা অন্তমিল বুঝে থাকেন। বিষয়বস্তু, শব্দ ব্যঞ্জনা যাই থাক না কেন, তারা কবিতার অন্তমিলকে এবং গীতিময়তাকেই কবিতার সর্বস্ব মনে করেন।
কবিতা নীতি শিক্ষার মাধ্যম নয়। কবিতাকে নিঃসন্দেহে শিল্প বলতে হবে। কারণ এখানে শাব্দিক কারুকার্য আছে। আঙ্গিকের লক্ষণীয় সৌষ্ঠব আছে, সৌন্দর্য বিকাশ আছে, আছে বিষয়বস্তুর সুন্দরতম বিন্যাস। কোন নীতিকে আশ্রয় করে বাঁধা ধরা নিয়ম কানুনকে গ্রহণ করে কোন মহৎ শিল্প সৃষ্ট হতে পারে না। সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, সুনীতি-দুর্নীতি, কাম-ক্রোধ ইত্যাদির সম্মিলনেই মানুষের জীবন। ষোল আনা ভাল বা ষোল আনা মন্দ কোনো মানুষ বিরল। জীবনে অপূর্ণতা আছে ভাল মন্দ আছে, সুতরাং কবিতা যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে তাহলে এখানে মহামানবোচিত জীবনাঙ্কন কিংবা নীতি শিক্ষা কাম্য হতে পারে না।
আধুনিক কবিতা জীবনের দুঃখ দুর্দশার মাঝে, আশা-নৈরাশ্যের মাঝে সংগ্রামী আহবানে জীবনের ধ্বনি জাগিয়ে তোলে। সুতরাং আজকের কবিতায় গীতি মূৰ্ছনার চেয়ে প্রচলিত জীবন ও বাস্তবতা অধিক গ্রহণীয়। অন্তচ্ছন্দ কবিকে তার স্বাধীনতায় বা স্বকীয় পথ চলায় বাধা সৃষ্টি করে।
আমরা যে আধুনিকতার কথা বলি এই আধুনিকতা আসলে শুরু হয় বিশ শতকের ত্রিশের দশকে। বাংলা কবিতা তখন রবীন্দ্র ছেড়ে বিশ্ব সাহিত্য স্থান করে নেয়। আগের কবিতা গুলো কোন শিক্ষিত মানুষ সহজেই বুঝে নিতে পাড়তো কিন্তু আধুনিক কবিদের কবিতা বোঝা দূরহ কাজ। আধুনিক কবিরা কবিতায় আবেগের চেয়ে মননশীলতা কে প্রাধান্য দেন। তাদের বলার ভাষা খুব সহজ কিন্তু অর্থ বোঝা কঠিন। তারা প্রায় সবাই ছিলেন অসম্ভব সুশিক্ষিত মানুষ।পৃথিবীর সমস্ত সাহিত্য ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নিরেট বাস্তবতা, ধূলির ধরণী আধুনিক কবিতার উপজীব্য। চাঁদ এ যুগে তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে কবিতায় একখানা ঝলসানো রুটি হিসাবে রূপায়িত হয়েছে। আধুনিক কবিতার বিবর্তনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একটি মৌলিক কারণ। কোনো অলৌকিক কল্পনার স্থান আধুনিক কবিতায় নেই। ব্যক্তি এখন নিজস্ব চিন্তা চেতনায় অন্যের চেয়ে স্বতন্ত্র। ঐশ্বরিক আবেগের চেয়ে জাগতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, দুঃখ-বেদনা, জীবন-সগ্রাম, প্রেম-প্রকৃতি, স্বদেশ-স্বরাজ অধিক স্থান পাচ্ছে আধুনিক কাব্যে। প্রাচীন মনসামঙ্গল কাব্যে আমরা স্বতন্ত্রর চরিত্র পাই। যার নাম চাঁদ সওদাগর। সে তার সমস্ত কিছু শেষ হওয়ার পরেও মনসা দেবীকে অস্বীকার করেছে। চাঁদ সওদাগর প্রাচীন কাব্যের একটি চরিত্র হয়েও সে চিরকাল আধুনিক। কারণ আধুনিকতা সময়ের দিক থেকে সর্বদা নিরুপণ হয় না, হয় রুচিবোধের দিক থেকে, শৈলীর দিক থেকে এবং মানসিকতার দিক থেকে। সেই দিক থেকে “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণীর” কবি আব্দুল হাকিম কিংবা “বিনা স্বদেশীভাষা পুরে কি আশা’র কবি রাম নিধিগুপ্ত” “সবার উপরে মানুষ সত্যের কবি” চন্ডীদাস কিংবা “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”র লালন ফকির প্রাচীন হয়েও আধুনিক। সেই অর্থে কবিকে সাংবাদিক বলা চলে, কারণ তারা সত্য ও বাস্তবতার সংবাদকে সুন্দরের থালায় পরিবেশন করে নিয়ে চলেন মন মনান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
আধুনিক কবিতাকে অবসরের সুখ পাঠ্য বলে ধারণা করাও অসঙ্গত। আধুনিক কবিতা পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার চেতনা জাগায়, নির্জীবকে সজীব, নিদ্রিতকে জাগ্রত করে। মৃত্যুর শীতলতায় মৃত্যুঞ্জয়ী স্বপ্ন দেখে। প্রচন্ড নৈরাশ্যের মধ্যেও জীবনের ক্ষণিক তৃপ্তি নিতে সে ভুল করে না। তাই কবিতা আজ উৎপীড়িতের মুখের তীব্র প্রতিবাদ, নিষ্পেষিত মানুষের কণ্ঠস্বর, বঞ্চিত মজুরের আর্তনাদ সংগ্রামী মানুষের মিছিল, মনো-দৈহিক কামনার সত্য ভাষণ। তাই কবিতা আলস্যের অনাবশ্যক সৃজন নয়, শুধু অবকাশের চিত্ত বিনোদন নয়, নিন্দা বন্দনা বা রাজার মনোরঞ্জন নয়। জীবন ও বাস্তবতায় কবিতা চলিষ্ণু জীবনের প্রতিচ্ছবি।
প্রত্যেক যুগেই সত্যকার মৌলিক সৃষ্টি সাধারণের নিকট অদ্ভুত মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলার এই প্রধান দুই কবিকে দুরূহতার অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিল। প্রেম ও জীবনবাদী কবি নজরুলকে কম অপবাদ দেওয়া হয়নি। এই যুগের জীবন অতি জটিল, অতি ব্যাপক এবং বহুমাত্রায় ব্যস্ত ও যান্ত্রিক। তাই আধুনিক কবির প্রকাশ ভঙ্গিও দুরূহ এবং বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠেছে। বর্হিজগত যতই সরলতাকে হারিয়ে গরলতায় যাচ্ছে, নিস্ফলা মরুভূমি হচ্ছে, কবি ততই তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অনন্তর্লীন ধ্যানরাজ্য তৈরি করে বাস্তবতাকে স্বীকার করেছেন। তাই আধুনিক কবিরা পাঠক সাধারণকে তাদের জটিল অভিজ্ঞতার অংশীদার করতে চান। অতএব কবিতা বুঝতে গেলে আর নিষ্ক্রিয়তা নয়, সক্রিয় অধ্যবসায়ই কবিতা উপভোগর চাবিকাঠি। সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় “যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য কবিকে দোষারোপ অন্যায়” কাব্য যদি জীবনের মুকুর হয় তবে এই জটিল যুগের প্রতিবিম্ব তাকে আরো জটিল করে তুলবে, এতে আশ্চর্য কি?
আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য : কবিতার সেই প্রাচীন স্বপ্নাবিষ্ট সরলতা ছেড়ে কেন তা আজ জটিল পান্ডিত্যপূর্ণ মনে হয় তারও বস্তুগত ব্যাখ্যা আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই কাব্য সাহিত্য বর্তমান পথ ধরে চলতে শুরু করেছে। যুগের যন্ত্রণাই এর প্রধান কারণ। ভাবের দিক থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার লক্ষণসমূহ হলো-
ক. নগর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত।
খ. বর্তমান জীবনের ক্লান্তি ও নৈরাশ্যবোধ।
গ. আত্ম বিরোধ বা অনিকেত মনোভাব।
ঘ. বৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য গ্রহণ।
ঙ. ফ্রয়েডীর মনোবিজ্ঞানের সূত্রে অবচেতন মনের ক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়া।
চ. ফ্রেজার প্রমুখ নৃতাত্ত্বিক, আইনস্টাইন প্রমুখ পদার্থ বিজ্ঞানীর সৃষ্টিকর্মের প্রভাব।
ছ. মার্কস, লেনিন প্রমুখের সাম্যবাদী চিন্তা ধারার প্রভাবে নতুন সমাজ সৃষ্টির প্রয়াস।
জ. মননধর্মিতা অনেক সময় বিপুল একাডেমিক শিক্ষা বা জ্ঞানেরভাবে দুরহতার সৃষ্টি।
ঝ. বিবিধ প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ বিষয়ে অবিশ্বাস ও সংশয়, অনিশ্চয়তার বহিঃপ্রকাশ।
ঞ. দেহজ কামনা বাসনা প্রসূত অনুভূতিকে স্বীকার করা এবং প্রেমের শরীরি রুপকে প্রত্যক্ষ করা।
ট. অলৌকিক ও প্রথাগত নীতি ধর্মে প্রচন্ড অবিশ্বাস।
ঠ. ঐতিহ্য গত রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহ এবং নবতর সৃষ্টির পথ অনুসন্ধান ইত্যাদি।
কাব্য রচনায় ভাবের সঙ্গে শৈলী ও প্রকরণ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাধারণত: আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়-
ক. গদ্যের ভাষা, প্রবাদ প্রবচন, চলতি শব্দ, গ্রাম্য শব্দ ও বিদেশী শব্দের ব্যবহারে গদ্য পদ্য ও কথ্য ভাষার ব্যবধান বিলোপের চেষ্টা। অর্থাৎ ভাষা সম্পর্কে সর্বপ্রকার শুচিবায়ু পরিহার।
খ. প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের পুরাণ এবং বিখ্যাত কবিদের কাব্য অথবা ভাবনা থেকে উদ্ধৃতির প্রয়োগে করা বা অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন অনুভূতির সমন্বয় সাধন।
গ. খ্যাতিমান কবির প্রসিদ্ধ উপমা ও বর্ণনার বিরলতম ব্যবহার কিংবা প্রচলিত কাব্যিক শব্দ বর্জন।
ঘ. শব্দ প্রয়োগে বা গঠনে মিতব্যয়িতা এবং অর্থ ঘনত্ব সৃষ্টির চেষ্টা।
ঙ. প্রচলিত পয়ার সনেট ও মাত্রা প্রধান ছন্দের অভিনব রূপান্তর এবং মধ্য মিলের সৃষ্টি, অন্ত্যমিল বর্জন।
চ. গদ্য ছন্দের ব্যবহারে বহুমাত্রিক ভাবধারা, প্রভৃতি।
মোটামুটিভাবে আধুনিক কবিতায় এই সমস্ত লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। এই লক্ষণগুলির যত বেশি প্রকাশ ঘটবে ততই কবিতাকে আধুনিক বিবেচনা করা সম্ভব। বাংলার আধুনিক কবিদের মধ্যে কবিতায় এই লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছে পঞ্চপাণ্ডবদের লেখায়।
১৯৩০ সালের পর থেকেই এ আধুনিক কবিতার স্রষ্টা তথা আধুনিক কবিগণের বিকাশ ঘটে। আধুনিকতার অনুসারী কবিগণের মধ্যে জীবনান্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কালের দিক থেকে এ পাঁচ জন বা পঞ্চপান্ডবের কাব্যের বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্র প্রতিভা হতে মুক্তিলাভ।
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। তিনি বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, কবিতাকে করেছে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। নিচে তার পরিচয় ও কবিতায় অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :
জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ (বরিশাল)
উপাধি : ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি (বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক অভিহিত), পরা বাস্তবতার কবি, বিপন্ন মানবতার নীলকণ্ঠ কবি।
কাব্যগ্রন্থ : ‘মহাপৃথিবী’, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেন’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘ঝরা পালক’, ‘ধুসর পান্ডুলিপি’।
তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতি। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বাংলা কবিতায় উত্তর আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। প্রকৃতি আর প্রেম তাঁর কবিতায় অসাধারণ রূপকল্পনাময় অভিব্যক্তি পেয়েছে। স্বদেশ, সমাজ-সমকাল, নির্জনতা, মুগ্ধতা, একাকিত্ব কবিতার প্রধান উপজীব্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থেকে তিনি কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন।
আধুনিক বাংলা কবিতা’র ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার চারিত্র্যলক্ষণ আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ জীবনানন্দ দাশ সেই কবি যাঁর কবিতায় এসব অনুষঙ্গের সন্ধান মেলে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে।
তার এই সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যেকে এক নতুন দিশায় নিয়ে এসেছে। তার কবিতায় আধুনিকতা ফুটে উঠেছে খুব গুরুত্বের সহিত। ফলে আমরা বলতে পারি যে, বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের অবদান অনস্বীকার্য।
মৃত্যু: মহান এই কবি ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ (কলকাতায় ড্রামের নিচে পড়ে আহত হন এবং হাসপাতালে মারা যান।)
অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬)
আধুনিক কবিদের মধ্যে সর্বাধিক জটিল এবং দ্বিধাবিভক্ত কবি মানসের অধিকারী। তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিগত সচিব ছিলেন। তথাপি রবীন্দ্র প্রতিভা বিরোধী।
তার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ: ‘খসড়া’, ‘এক মুঠো’, ‘মাটির গান’, ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’, ‘দূরবাণী’, ‘পারাপার’, ‘পালাবদল’, ‘ঘরে ফেরার দিন’, ‘হারানো অর্কিড’, ‘পুষ্পিত ইমেজ’, ‘অনিঃশেষ’ প্রভৃতি।
অমিয় চক্রবর্তী দেখিয়েছেন উপমা ছাড়াও কবিতা হয়। তাঁর কবিতার ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের কৌশল, পঙক্তি গঠনের নিয়ম বাঙালি কবিদের মধ্যে অনন্য সাধারণ। সংস্কৃত শব্দ তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সাথে সাথে অবচেতনার যে সদৃশ আছে তা তিনি দেখিয়েছেন সুনিপুণতায়। বুদ্ধদেব বসু অসংকোচে অমিয় চক্রবর্তীকে বলতেন ‘কবির কবি’। কবি আল মাহমুদ অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত না করে করেছিলেন বিস্মিত ও অভিভূত।
তার মিল ও পঙক্তি বিন্যাসের অনভ্যস্ত প্রয়োগ আমার কাছে কিছু দিন অত্যন্ত লোভনীয় মনে হলেও এর দুরূহতা শেষ পর্যন্ত আমাকে নিশ্চেষ্ট না করে ছাড়ে নি। এমন কী পয়ারের কারুকাজেও।’ আবদুল মান্নান সৈয়দও অমিয় চক্রবর্তীর সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাঁর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চিৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে: মননাশ্রিত, অ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়।’ তাঁর কবিতার ভিতরে আবেগের সঙ্গে মিশে আছে মননশীলতা। প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য বেশি পেলেও তাঁর কবিতা ছিল সম্পূর্ণ রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত। এই জন্যই তাকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ পঞ্চপাণ্ডবদের একজন ধরা হয়।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ – ১৯৬১)
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অন্যতম একজন। তিনি বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এই অবদান বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধশালী, কবিতাকে করেছে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। নিচে তার পরিচয় ও কবিতায় অবদানের কথা উল্লেখ করা হলো :
কবিতা গ্রন্থ: ‘তন্বী’, ‘অর্কেষ্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘সংবর্ত’, ‘প্রতিদিন’, ‘দশমী’।
ইউরোপীয় বিভিন্ন কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ- ‘প্রতিধ্বনি’।১৯৩১ সালে তিনি ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন।সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে জর্জরিত। তিনি আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে নতুনত্বের সন্ধানী। বাংলা কাব্যে তিনি নৈরাশ্যবাদের আত্মার সন্তান। সুধীন দত্ত জড়বাদী ও ক্ষণবাদী দর্শনের অভিব্যক্তির অন্তরালে আধুনিক দার্ঢ্য, অভিজাত কাব্যভাষার উদ্ভাবক। স্বদেশ-বিদেশের কোনো কোনো কবির সঙ্গে কাব্য নির্মাণে ও কাব্যভাষায় সংযুক্ত হলেও তিনি সেসব কবির আপাত ও লুকানো প্রভাব ছাড়িয়ে আপন মৌলিকতাকে করেছেন সুস্পষ্ট। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র, একাকী ও উত্তর সাধকের বিস্ময়স্থল।
বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২)
মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বিষ্ণু দে ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নব্যধারার আন্দোলনের প্রধান পাঁচজন কবির অন্যতম ছিলেন। বিষ্ণু দে, জীবনের কোন এক সময়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার প্রবাহিত ধারার মধ্যে দিয়েও সময় কাটিয়েছেন; যা আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত বেশ কিছু কবিতায়।
রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতি সচেতনতা; বাংলাদেশের লৌকিক যাপিত জীবনচর্চার প্রতি অনুরাগ, গভীর অনুভূতি প্রিয়, পুরাণ এবং ইতিহাস জাগ্রতবোধ, ছন্দের সুচারু সার্থক ব্যবহার, বিচিত্র বিন্যাসে কবিতায় মিলের চমক, শব্দ প্রয়োগের নৈপুণ্য এবং সর্বোপরি এক বিরাট বিশ্ব ও মানবিকবোধে নিমগ্ন আধুনিক কবি বিষ্ণু দে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন প্রথম জীবনে।
এছাড়া তিনি কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিরিশের প্রধান কবিদের একটি দিক খুব স্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয়; আর তা হলো তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ এবং নিজস্বতার পরিচয়। যে দৃষ্টিকোণ আর নিজস্বতা থেকে বাদ যাননি বিষ্ণু দে-ও। কখনো সেটাই দেখা দিয়েছে কবিতার শব্দের রুচির ব্যাপার হ’য়ে। বিষ্ণু দে ব্যক্তিগত শোক, দুঃখ, অনুতাপ, আবেগ আর অনুশোচনাকে নিয়ে আসেননি তাঁর কবিতায়। কিন্তু তাঁর কবিতা থেকে গেছে ভাষা সংহত এক কবিতা হয়ে; যা হয়ে উঠেছে এক বিশুদ্ধ কবিতা রূপে। যে ভাষা তিনি নির্বাচন করেছেন তা হয়ে উঠেছে একান্তভাবে বিষ্ণু দের ভাষা ; যে ভাষা প্রসারিত রূপ পেয়েছে তাঁর-ই কবিতায়।
অনুবাদ : ‘এলিয়টের কবিতা’।
১৯২৩ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের ফলে জন্ম নেয়া সাহিত্য গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য।
প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘উর্বশী ও অার্টেমিস’, ‘চোরাবালি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ’, ‘সেই অন্ধকারে চাই’, ‘ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাসে’, ‘রবিকরোজ্জল নিজদেশে’, ‘দিবানিশি’, ‘চিত্ররূপমত্ত পৃথিবী’, ‘উত্তরে থাকা মৌন’, ‘ আমার হৃদয়ে বাঁচো’, ‘পূর্বমেঘ’, ‘সন্দীপের চর’, ‘অনিষ্ট’, ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’।
বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ -৭৮)
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবি ও কবিতার আলোচনায় বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) নাম অবধারিতভাবেই এসে যায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যবিস্তারকে পাশ কাটিয়ে বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র সরণি নির্মাণের যে প্রয়াস তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। বুদ্ধদেব বসু সেই সরণি নির্মাণের অন্যতম কারিগর।
কেবল অভিনব কবিতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর প্রয়াস সীমাবদ্ধ রাখেননি। আন্তর্জাতিক কাব্যপ্রবাহের সঙ্গে বাংলা কবিতার সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াস উত্তর-প্রজন্মের কবি সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে কলোনিয়াল সমাজের নগর-মানুষের পরিপার্শ্ব – হতাশা, বিপন্নতা, আশা-স্বপ্নকে নিজের কল্পনামুগ্ধতা দিয়ে সবার করে তুলতে পেরেছিলেন।
বিখ্যাত “কবিতা” তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা।
১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ লাভ করেন।
কাব্যগ্রন্থ : ‘মর্মবাণী’, ‘বন্দীর বন্দনা’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘কঙ্কাবতী’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’, ‘একদিন চিরদিন’।
ফলে পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পঞ্চপান্ডব বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছে। তাঁরা বাংলা কবিতায় বিকাশ ঘটিয়েছে আধুনিকতার। তাঁরা বাংলা সাহিত্যেকে করেছে সমৃদ্ধ এবং কবিতাকে করেছে প্রাণবন্ত। বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে তাঁরাও অমর হয়ে থাকবে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।