ভাঙা চশমা গল্পের বিষয়বস্তু: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্যিক এবং চল্লিশের দশকের প্রধান গল্পকারদের মধ্যে একজন। তাঁর গল্পে তৎকালীন সমাজের বিপর্যস্ত জীবন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, যুদ্ধ, গণবিক্ষোভ, রক্তাক্ত স্বাধীনতার লড়াই, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যার নির্মম প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন বাংলার জীবন এবং সমাজের বাস্তবিক চিত্র তিনি দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তাঁকে সেই দশকের এক বিশেষ প্রতিনিধি গল্পকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
‘ভাঙা চশমা’ গল্পের কেন্দ্রীয় ভাবনা ও বিশ্লেষণ
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাঙা চশমা’ গল্পটি সমাজকেন্দ্রিক জীবন ও যুদ্ধকালীন বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পের প্রধান চরিত্র একজন স্কুলের মাষ্টারমশাই, যিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা প্রথম পুরুষে বর্ণনা করেছেন। গল্পের শুরুতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কন্ট্রোল আর কালোবাজারের উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাদেরকে যুদ্ধজনিত অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে পরিচিত করে। গল্পের কথক, ষাট টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে সরকারি কাজে যোগ দেন এবং মফস্বল অঞ্চলে যুদ্ধের সময়ে ক্ষুধার্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের মধ্যে সরকারি সাহায্য বিতরণে নিয়োজিত হন।
একদিন কথকের দেখা হয় জনশূন্য গ্রামে বসবাসরত এক হেডমাস্টারের সঙ্গে, যিনি জীবনের সবকিছু দিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার স্কুল দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ছাত্রশূন্য হয়ে গেছে, অথচ তিনি সেই বিদ্যালয় আঁকড়ে ধরে আছেন এবং শূন্য শ্রেণিকক্ষে কল্পিত ছাত্রদের জন্য প্রিপোজিশন পড়াচ্ছেন। তাঁর নিষ্ঠা দেখে গল্পের কথক বিমুগ্ধ হন, কিন্তু সেই হেডমাস্টার ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘আমার সারাজীবনের সব কিছু স্বপ্ন এমন করে কে শেষ করে দিল বলতে পারেন?’ কথকের মনে হয় তিনি নিজে যেন এই পবিত্র বিদ্যালয়ে অযোগ্য; তাঁর স্পর্শে যেন বিদ্যালয়ের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। নিজের লোভ ও স্বার্থপরতার জন্য তিনি আত্মগ্লানি অনুভব করেন এবং সেখান থেকে পালিয়ে আসেন।
এই গল্পে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক সংকটের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজের মনকে তুলে ধরেছেন। গল্পে তিনি আদর্শ, নীতি এবং ত্যাগের অনুপম দৃশ্যপট সৃষ্টি করেছেন। হেডমাস্টারের মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের চিত্রের মাধ্যমে এক চিরন্তন আদর্শের স্থির দীপশিখার অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে, যা সহস্র বাধা-বিপত্তির মধ্যেও অটুট, অপরিবর্তনীয় এবং সুন্দর। প্রধান চরিত্রের আত্মধিক্কার ও ব্রতচ্যুতির মধ্য দিয়েও গল্পে এক অনন্ত আশ্বাস, মহত্বের চিরকালীন স্থায়ীত্ব ও মহত্ত্ববোধের বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়, যা এই গল্পটিকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরও গভীর ও মানবিক করে তুলেছে।