Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য: বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, এটি এমন একটি সময় যা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পটভূমিতে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এবং এই সময়ে সাহিত্য, শিল্প এবং সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নলিখিত পয়েন্টের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে:

১. সমাজ সচেতনতা ও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা

আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সমাজ সচেতনতা। এই সময়ের সাহিত্যিকরা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, কুসংস্কার, এবং বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন। সমাজে নারীদের অধিকারহীনতা, জাতপাতের বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, এবং দরিদ্রের প্রতি অবহেলার বিষয়টি তাঁদের লেখনীতে ফুটে উঠেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ লেখকগণ সমাজ সংস্কারের দিক থেকে বিশেষ অবদান রাখেন।

২. মানবতাবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রাধান্য

আধুনিক বাংলা সাহিত্য মানবতাবাদ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পূর্ববর্তী যুগে সাহিত্য ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়মের প্রতি অনুগত; কিন্তু আধুনিক যুগে সাহিত্যিকরা ব্যক্তির স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং মানবতার দিকে দৃষ্টি দেন। এই সময়ে মনোবিশ্লেষণ, আত্মোপলব্ধি এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

৩. দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা

উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম এবং জাতীয় চেতনার প্রভাব ব্যাপকভাবে দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের উদ্দীপনামূলক রচনা যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গান জাতীয়তাবোধকে শক্তিশালী করে।

৪. নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

আধুনিক যুগে নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে লেখকদের মধ্যে চিন্তার বৈচিত্র্য দেখা যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’ এবং ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, অধিকার এবং সামাজিক অবস্থানের প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। এর ফলে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়।

৫. বাস্তববাদ ও জীবনের বাস্তব চিত্র

আধুনিক বাংলা সাহিত্য বাস্তববাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আগে যেখানে সাহিত্যিক কল্পনা, রূপক এবং অলৌকিকতার প্রাধান্য ছিল, আধুনিক যুগে বাস্তব জীবনের সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক বাস্তববাদী ধারা প্রবর্তন করেন এবং তাদের লেখায় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, আর্থ-সামাজিক সংগ্রাম ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেন।

৬. মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আধুনিক যুগে মানুষের মনের গভীরতম অনুভূতি ও মনের জটিলতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। লেখকরা চরিত্রগুলোর মানসিক দ্বন্দ্ব, ভয়, হতাশা, এবং অন্তর্দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগুলো এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।

৭. নগর জীবন ও শহুরে পরিবেশের চিত্র

আধুনিক যুগে শহুরে পরিবেশ এবং নগর জীবনের কঠিন বাস্তবতা সাহিত্যিকদের লেখনীতে প্রধান হয়ে ওঠে। শহরের যান্ত্রিকতা, মানুষে-মানুষে দূরত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জীবনের অনিশ্চয়তা আধুনিক সাহিত্যে দেখা যায়। বিশেষত জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কলকাতার শহুরে জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।

৮. বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রভাব

আধুনিক যুগে বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হয়। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলা সাহিত্যে তা প্রতিফলিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি ও লেখকেরা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং প্রাচীন কুসংস্কারের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

৯. ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির নতুনত্ব

আধুনিক যুগের লেখকরা সাহিত্যে ভাষার প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তাঁরা ভাষাকে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল করার চেষ্টা করেন, যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় যেমন ভাষার সরলতা ও মাধুর্য লক্ষ করা যায়, তেমনি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ভাষার ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবহার পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারার সূচনা করে।

১০. শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা

বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক অসাম্য, শ্রেণিবিভাজন, কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা, এবং সমাজের অবহেলিত মানুষের অবস্থান নিয়ে লেখকেরা সাহিত্য রচনা করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতিফলন দেখা যায়।

১১. দারিদ্র্য এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র

আধুনিক সাহিত্যে দারিদ্র্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনের চিত্র যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম ও জীবনযাত্রার কাহিনী তুলে ধরেছেন লেখকরা। বিশেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ এই দারিদ্র্য এবং গ্রামীণ জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

১২. প্রকৃতিপ্রেম ও পরিবেশ সচেতনতা

আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্য প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং পরিবেশের প্রতি সচেতনতার অভিব্যক্তি দেখা যায়। জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ পেয়েছে।

১৩. দার্শনিক চিন্তাধারা

আধুনিক যুগের সাহিত্যে জীবন, মৃত্যু, সময় এবং অস্তিত্বের মতো গভীর দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা দেখা যায়। জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শামসুর রাহমানের কবিতায় এই দার্শনিক চিন্তাধারার প্রভাব স্পষ্ট। তাঁরা অস্তিত্বের সংকট, জীবনের অর্থহীনতা, সময়ের অমোঘ গতি সম্পর্কে তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন।

১৪. প্রান্তিক ও অবহেলিত মানুষের কণ্ঠস্বর

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রান্তিক, অবহেলিত এবং সমাজের নিচু স্তরের মানুষের দুঃখ, কষ্ট এবং বঞ্চনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যিকরা তাদের গল্প তুলে ধরেন, যা আধুনিক সাহিত্যের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

১৫. নতুন কবিতা ও কাব্যরীতির সূচনা

আধুনিক যুগে কবিতায় নতুন রীতি, ছন্দ এবং গদ্যধর্মী কাব্যের বিকাশ ঘটে। জীবনানন্দ দাশের নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার পথ চলা শুরু হয়, যেখানে ছন্দবদ্ধতার বাইরেও কবিতার স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গি তৈরি হয়। তাঁর কবিতায় কাব্যের গদ্যময়তা, ছন্দের ভাঙন এবং প্রকৃতির বিমূর্ততা ফুটে ওঠে।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে একটি বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এই সময়ে সাহিত্যিকরা ব্যক্তির মানসিক অবস্থা, সামাজিক অসাম্য, জাতীয় চেতনা এবং মানবতার প্রশ্ন নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁদের কাজ বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং এর মাধ্যমে সমাজের প্রগতির পথে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.