Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা পত্রের কাব্যশৈলী বিচার কর

‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ কাব্যের প্রথম পত্রটি সত্যিই একটি চমৎকার এবং গভীর অনুভূতির প্রকাশ। এখানে কবি মধুসূদন দত্ত শকুন্তলার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মনের অবস্থা তুলে ধরেছেন, যা শ্রীকালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটক এবং মহাভারতের সূত্রে প্রভাবিত।

এই পত্রের মূল বিষয় হলো শকুন্তলার প্রতীক্ষা ও আকুলতা, যেখানে তার প্রেমিক দুষ্মন্তের প্রতি আবেগময় অনুযোগ প্রকাশিত হয়েছে। কবি অত্যন্ত নিপুণভাবে শকুন্তলার অনুভূতিগুলোকে নাটকীয় ও আবেগময় ঢঙে বর্ণনা করেছেন। প্রথম স্তবকে শকুন্তলা নিজের পরিচয়ে দাসী হিসেবে দুষ্মন্তকে প্রণাম জানিয়ে তার বক্তব্য শুরু করে, যেখানে তার মনে জন্ম নেয় বিভিন্ন আবেগ—প্রতীক্ষা, অবহেলা, এবং অবিশ্বাস।

শকুন্তলার স্বপ্নচারণা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তার অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্রায়ণ কাব্যটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। যেমন, প্রকৃতির সাথে তার মনের অবস্থার তুলনা অত্যন্ত গূঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এইভাবে, কবি নায়িকার অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভূতির দ্বৈত সত্ত্বাকে প্রকাশ করেছেন।

কাব্যের মধ্যবর্তী অংশগুলোতে শকুন্তলার স্মৃতি রোমন্থন এবং দুষ্মন্তের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে, যা নারী হৃদয়ের যন্ত্রণা ও অভিমানকে স্পষ্ট করে। বিশেষ করে, ষষ্ঠ স্তকে শকুন্তলার দুষ্মন্তের প্রতি ক্ষোভ এবং অভিযোগ প্রতিফলিত হয়েছে, যা তার নিজস্ব আত্মমর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

মহাভারত ও কালিদাসের নাটকের প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন পথে কাব্যটির নির্মাণের ফলে এটি একটি মৌলিক রূপ ধারণ করেছে। কবি শকুন্তলার পত্র রচনার প্রেক্ষাপটকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর কাব্যশৈলী ও চিন্তার গভীরতা প্রতিফলিত করে।

শুধু শকুন্তলার দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং নারীর যন্ত্রণার স্বরূপ ও সামাজিক অবস্থানও এখানে তুলে ধরা হয়েছে, যা পাঠকদের মনে এক গভীর চিন্তার সৃষ্টি করে। এটি কেবল একটি প্রেমের কাহিনী নয়, বরং নারীর অবস্থান ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নেও আলোকপাত করে।

এই কাব্যের প্রতিটি স্তবক যেন শকুন্তলার হৃদয়ের গভীর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার একটি যাত্রাপথ, যা পাঠককে তার দুঃখ, আশা, ও আত্মমর্যাদার চেতনায় প্রবাহিত করে। এটি বাঙালি সাহিত্যে নারীর চরিত্র নির্মাণের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।

‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ কাব্যের দ্বাদশ স্তবকে শকুন্তলার আত্মপরিচয় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে শকুন্তলার আত্মনিবেদন ও স্বামী দুষ্মন্তের প্রতি তার গভীর প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। ‘দাসী’, ‘অভাগী’, ‘পাগলিনী’, ‘অনাথিনী’ এই শব্দগুলির মাধ্যমে সে নিজেকে পরিচয় দিতে চেয়েছে, যা তার মনের অসহায়তা এবং প্রেমিকের প্রতি অনুরাগকে চিহ্নিত করে। এই অভিধাগুলির মাধ্যমে কবি শকুন্তলার অন্তর্দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন—সে একজন সাধারণ বনবাসিনী নারী, কিন্তু তার হৃদয়ে রাজা দুষ্মন্তের জন্য গভীর প্রেম।

আত্মনিবেদন ও পরিচয়ের পরিবর্তন

শকুন্তলার পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা এখানে একটি নাটকীয় চমক সৃষ্টি করেছে। প্রথমে সে নিজেকে ‘দাসী’ হিসেবে উল্লেখ করে, এবং শেষ পর্যায়ে এসে তার নাম প্রকাশ করে—‘দাসী শকুন্তলা দোষী ও চরণ যুগে?’ এই পরিবর্তন কবির কৌশলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শকুন্তলা প্রতিবার ‘দাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে নিজের আত্মসমর্পণ প্রকাশ করেছে, যা তার প্রেমিকা সত্তার পরিচয় বহন করে। এইভাবে, কবি নারীর আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে তোলা পাশাপাশি প্রেমের ঐশ্বর্য ও উন্মাদনা ফুটিয়ে তুলেছেন।

দাসী, অভাগী ও বনবাসিনী

শকুন্তলা ‘বন-নিবাসিনী’ বলে তিনবার উল্লেখ করেছে, যা তার অস্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ‘পাগলিনী’ শব্দটি প্রিয়ের বিচ্ছেদে তার উন্মাদনা প্রকাশ করে, যা তার অন্তর্দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করে। ‘অভাগী’ ও ‘অভাগিনী’ শব্দের ব্যবহার তার জীবনের অসহায়তা এবং রাজা দুষ্মন্তের প্রতি তার প্রেমের ক্ষতকে চিত্রিত করে।

রাজা দুষ্মন্তের প্রতি কটাক্ষ

“গন্ধব, বিবাহচ্ছলে ছলিলে দাসীরে” বাক্যটির মাধ্যমে শকুন্তলা দুষ্মন্তের চরিত্রের দুর্বলতা তুলে ধরেছে। এখানে রাজা দুষ্মন্তের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং শকুন্তলার মর্মবেদনা স্পষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে, সে নিজের প্রেমের ক্ষতিতে বেদনার পাশাপাশি মুগ্ধতাও অনুভব করে।

নাটকীয়তার প্রতিফলন

কাব্যটিতে নাটকীয়তা এবং চরিত্রের গভীরতা তুলে ধরতে শকুন্তলা অনেক সময় অবজেক্টগুলোকে চরিত্র রূপে তুলে ধরে। যেমন, প্রকৃতি ও প্রাণীকে তার অনুভূতির প্রতিবিম্ব হিসেবে উপস্থাপন করে। তার বক্তব্যে “রে নিকুঞ্জশোভা, কি সাধে হাসিস তোরা?” বা “শোন, পত্র; সরস দেখিলে…” ইত্যাদি বাক্যগুলো তার মনের অবস্থাকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করে।

শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও আবেগ

শকুন্তলার সংলাপে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির উপস্থিতি দেখানো হয়েছে, যা তার প্রেমের প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন—“বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, পড়ি ভূমিতলে…” এই সব উল্লেখ শকুন্তলার বিরহবেদনার গভীরতা এবং তার প্রেমের আকাঙ্ক্ষাকে জীবন্ত করে তোলে।

মধুসূদনের কাব্যশৈলী

মধুসূদন কাব্যের প্রতিটি স্তবককে নাট্যধর্মী করে তুলতে শব্দচয়ন ও ছন্দের বিশেষ কৌশল ব্যবহার করেছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার কাব্যটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।

মোটকথা, ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’ কাব্যটি নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও প্রেমের যন্ত্রণাকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও নাটকীয়ভাবে তুলে ধরেছে। শকুন্তলার চরিত্র ও তার আত্মনিবেদন, প্রতীক্ষা এবং অবহেলা একে একে প্রকাশ পায়, যা পাঠককে গভীরভাবে স্পর্শ করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.