Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

বীরাঙ্গনা কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের নিপুণ শিল্প সৃষ্টি বা শিল্প কুশলতার- আলোচনা করো

মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দকে আশ্রয় করে বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক অভূতপূর্ব ধারা সৃষ্টি করেছেন পত্রকাব্যের মাধ্যমে। এই ধরনের পত্রকাব্য বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায় না। তবে গদ্যে রচিত পত্রোপন্যাস কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং আধুনিক সাহিত্যের কিছু ঔপন্যাসিক লিখেছেন। কিন্তু ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ তুল্য পত্রকাব্য আজও ‘একেবদ্বিতীয়ম্’।

যুগন্ধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে এগারোজন অঙ্গনাকে বেছে নিয়ে, তাদের মনোভাবের উপর ভিত্তি করে পত্র রচনা করেছেন তাদের প্রেমিক বা স্বামীর উদ্দেশ্যে। রচনাকৌশলে মনে হয় যেন ওই এগারোজন নায়িকা তাঁদের প্রেমিকদের উদ্দেশ্যে নিজেদের মনোভাব জানিয়ে নিজেই পত্র রচনা করেছেন। পত্রগুলির মধ্যে প্রতিটি নায়িকার চরিত্র, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, মনোভাব, ইচ্ছা, অনিচ্ছা চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এবং একই ধারায়, একই মনগত বাসনা প্রকাশিত পত্র হলেও, প্রতিটি পত্রের মধ্যেই স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান।

কবি বীরাঙ্গনা কাব্য রচনায় পৌরাণিক উপাদান ব্যবহার করেছেন তিনটি উপায়ে। (১) পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণ, (২) প্রয়োজনে সেই কাহিনী স্বেচ্ছামতো গ্রহণ-বর্জন অথবা আমূল পরিবর্তন, এবং (৩) পৌরাণিক পটভূমিতে রোমান্টিক আমেজ সৃষ্টি। মোটামুটিভাবে এই তিনটি ধারায় অনুবর্তিত হয়েছে বীরাঙ্গনা কাব্য এবং কাব্যের অঙ্গনাগণ।

বীরাঙ্গনা কাব্যের পঞ্চম সর্গে বর্ণিত শূর্পণখা পত্রিকার মধ্যেও কবির এই নবপুরাণ রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কবি এখানে শূর্পণখাকে এক প্রেমময়ী সুন্দরী যুবতী রূপে সৃষ্টি করেছেন। এই প্রসঙ্গে পত্রিকার ভূমিকায় তিনি পাঠকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন, পাঠকরা “বাল্মীকি বর্ণিত বিকট শূর্পণখাকে স্মরণপথ থেকে দূরীভূত করবেন।”

কবিগুরু বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে রাজেন্দ্র রাবণের বোন শূর্পণখাকে ভয়ানক রসের আবহে সৃষ্টি করেছেন। রাক্ষস রাজার বোন রাক্ষসী হওয়ার মধ্যে আর আশ্চর্যের কি! কিন্তু যখন সেই রাক্ষসীর মধ্যে প্রেমের সঞ্চার ঘটে তখন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে মানবী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। তাই শূর্পণখা তাঁর লেখনীর মাধুর্যে সুন্দরী যুবতী রূপে বর্ণিত হয়েছেন। এর আগে বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি মেঘনাদবধ কাব্যেও রাক্ষস রাজ ও তাঁর পরিবার সকলেই মানুষোচিত মহিমায় বর্ণিত হয়েছেন। তাদের তমঃ ভাব বীরেশ্বর্যে ভূষিত হয়েছিল। এখানেও শূর্পণখা প্রেমময়ী আর পাঁচজন সুন্দরী হৃদয়বতীর মতোই নিজেকে উজাড় করে দয়িতের উদ্দেশ্যে প্রেম নিবেদন করে তৃপ্ত হতে চান।

বীরাঙ্গনা কাব্যের শূর্পণখা বাল্যবিধবা। পঞ্চবটী বনে যখন রামচন্দ্র ও সীতার সঙ্গে লক্ষ্মণ বনবাসের কাল কাটাচ্ছেন—কঠোর কৃচ্ছসাধনে, তখন বাল্যবিধবা যুবতী শূর্পণখার মনে লক্ষ্মণকে দেখে প্রেমের সঞ্চার হয়। লক্ষ্মণের তরুণ যৌবনের অনিন্দ্য সৌন্দর্য তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে। তিনি লক্ষ্য করেন রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মানসদোসর সীতা রয়েছেন, কিন্তু লক্ষ্মণ একা। তাঁর মনে হয়েছে লক্ষ্মণ অবিবাহিত বলেই একা। তাই এই ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির প্রতি তাঁর মন আকর্ষিত হয়েছে এবং সঙ্গতভাবেই তিনি প্রেম নিবেদন করে লক্ষ্মণের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন।

পত্রের মধ্যে অনুরাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে শূর্পণখার স্বভাব চরিত্রও। শূর্পণখা কোমল চিত্তবৃত্তির অধিকারিণী। তাই অনিন্দ্য সৌন্দর্যের লক্ষ্মণের কৃচ্ছসাধন দেখে তাঁর কষ্ট হয়। সে কথা পত্রের প্রথমেই তিনি জানিয়েছেন—‘ফাটে বুক জটাজুট হেরি তব শিরে’। এবং এই বুক ফাটা শুধু কথার কথা নয়। ভালোবাসার পাত্রের দুর্বিসহ কষ্টের জন্যে তিনি তাঁর স্বর্ণশয্যায় শুতে পারেন না, রাজভোগ খেতে কষ্ট হয়, কারণ মনে পড়ে যায় তাঁর প্রিয়তম কেবল শুকনো ফলমূলমাত্র আহার করে জীবন ধারণ করছেন। এমনকি স্বগৃহে যেতেও তাঁর গতি মন্থর হয়ে যায় কেননা স্বর্ণগৃহের রম্যভবনে তিনি অবস্থান করবেন অথচ লক্ষ্মণ থাকবে বনের মধ্যে পর্ণকুটিরে।

ব্যথিত শূর্পণখা যে লক্ষ্মণকে সত্যিই ভালোবাসেন তা বোঝা যায় যখন তিনি লক্ষ্মণের সুখের জন্যে সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে রাজি হয়ে যান। এমনকি প্রেমিকার পক্ষে উচ্চারণ করা কঠিন এমন অঙ্গীকার করতেও তিনি দ্বিধা করেননি—“কহ শীঘ্র করি/ কোন্ যুবতীর নব যৌবনের মধু/ বাঞ্ছা তব? অনিমেষে রূপ তার ধরি,/(কামরূপা আমি, নাথ) সেবিব তোমারে।” এই উক্তি থেকে লক্ষ্মণের প্রতি তাঁর প্রেমের গভীরতা প্রকাশ পায়। তিনি অন্যান্য নারীদের মতো প্রিয়তমের সুখের জন্যে বা প্রিয়তমের সঙ্গ কামনায় রাজসুখভোগ ত্যাগ করে শুধুমাত্র বান্ধলাবৃত শরীরে প্রিয়তমের অনুসরণ করতে পারেন তো বটেই সেই সঙ্গে, প্রিয়তমের মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্যেও নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন।

পৌরাণিক কাহিনীতে ইতিপূর্বে দেখা গেছে, অগ্নিকে ভালোবেসে স্বাহা সপ্তর্ষির ছয় পত্নীর রূপ ধারণ করে মিলিত হয়েছিলেন। এখানেও শূর্পণখা সেই রকম অন্যের রূপ ধারণ করে প্রিয়তমকে আনন্দ দিতে চান। কিন্তু তফাৎ এই যে, স্বাহা কেবলমাত্র নিজ অভীষ্ট পূরণের জন্যে অথবা প্রিয় মিলন বাসনায় অগ্নিকে না জানিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে ছয় বার প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু শূর্পণখা প্রেমের ক্ষেত্রে নিজের চেয়ে লক্ষ্মণকে, লক্ষ্মণের আনন্দ বিধানকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি মাত্রায়।

প্রেমাস্পদের কাছে কিছুই তিনি গোপন রাখতে চাননি। এমনকি তাঁকে ভালো লাগা বা মন্দ লাগার অধিকারও প্রেমাস্পদের ওপর ন্যস্ত করে প্রেমাস্পদের ইচ্ছাকেই বড় করে দেখতে চেয়েছেন। তাই আবেদনপূর্ণ পত্রে তিনি লিখেছেন—

“কি রূপ বিধাতা

দিয়াছেন, আশুআসি দেখ, নরমণি।

আইস মলয় রূপে; গন্ধহীন যদি

এ কুসুম, ফিরে তবে যাইও তখনি!”

এবং আত্মপরিচয় জানাতে গিয়ে, তিনি যে রাবণের বোন, ঐশ্বর্য সুখে লালিত একথা জানাতেও কুণ্ঠিত হননি। তিনি সর্বপ্রকারে সহায়িকা রূপে লক্ষ্মণের কাছে নিজেকে তুলে ধরেছেন। ‘দাসীভাবে সেবিবে এ-দাসী’ বলে আবেদন জানালেও মনে তাঁর সংশয় রয়ে গেছে। কিন্তু সে সংশয় আনন্দে পরিপূর্ণ। কারণ রাক্ষস রাজের বোন কখনও প্রত্যাখ্যাত হয়নি। তাই যখন—

“আনন্দে বহিছে

অশ্রুধারা। লিখেছে কি বিধাতা এভালে

হেন সুখ প্রাণসখে?”

এই উক্তি শূর্পণখা করেন তখন তলে তলে তাঁর বিপুল অহংকারটাই প্রকট হয়ে পড়ে।

সমগ্র পত্রিকার বিচারে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যে শূর্পণখা দোষে গুলে মিশ্রিত একজন প্রেমময়ী যুবতীরূপেই চিত্রিত হয়েছেন। বাল্মীকির শূর্পণখার সঙ্গে তার আসমান জমিন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মোহিতলাল মজুমদার এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম: ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু: ২৬ জুলাই, ১৯৫২) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং প্রবন্ধকার। তিনি তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি,

Read More

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্মঃ ২১ ডিসেম্বর, ১৮২৭— মৃত্যুঃ ১৩ মে, ১৮৮৭) বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং

Read More

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে কোন পত্রিকার মাধ্যমে? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা কে? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের স্লোগান কী ছিল?

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারবিরোধী একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে

Read More

কোন চিত্রশিল্পী পটুয়া নামে খ্যাত? চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান

চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান ‘পটুয়া’ নামে খ্যাত। কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর ১৯২১ – ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) প্রখ্যাত বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী। তিনি ড্রইং-এ দক্ষতা অর্জন করে বিশ্বব্যাপী সুনাম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.