Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

পৌরাণিক উপাদানে গঠিত হলেও বীরাঙ্গনা কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তর মৌলিক সৃষ্টি

মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনবদ্য সৃষ্টি এবং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মতে সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি বীরাঙ্গনা কাব্য বীর রমণীদের পত্রাবলী দ্বারা নির্মিত। নায়িকাগণ তাঁদের হৃদয়াবেগ-উচ্ছৃত সংলাপ বা বক্তব্য পত্রাকারে তাঁদের প্রিয় বা পতির কাছে প্রেরণ করেছেন। পত্রিকা রচনার ধারা একোক্তিমূলক এবং নাটকীয়তাপূর্ণ। এ ধরনের পত্রকাব্য বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম এবং বোধ করি এই কাব্যই শেষ পত্রকাব্য। পরবর্তী কালে এই ধারায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘গান্ধারীর প্রতি ধৃতরাষ্ট্র’, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ ‘কচ দেবযানী’ ইত্যাদি কবিতা কাব্য-নাট্য রচনা করেছিলেন কিন্তু পত্র-কাব্য রচনা করেন নি। কবিতায় তিনি অনেক চিঠিও লিখেছিলেন। কিন্তু তাকে পত্রকাব্য বলা চলে না। তাই বাংলা সাহিত্যে বীরাঙ্গনা কাব্যকেই একমাত্র পত্রকাব্য হিসেবে মর্যাদা দান করা হয়ে থাকে।

বিভিন্ন সাক্ষ্য এবং মধুসূদনের লেখা চিঠিপত্র থেকে জানতে পারা যায় যে, কবি এই কাব্য রচনা করেছিলেন, রোমক কবি ওভিদের দি হেরোইদেস-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। কবি ওভিদ যেমন পাশ্চাত্য পুরাণ ও মহাকাব্যের থেকে নায়িকাচরিত্র চয়ন করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁদের জবানীতে তাঁদের প্রিয় বা পতির কাছে পত্র প্রেরণ করিয়েছেন কবি মধুসূদনও তেমনি ভারতীয় পুরাণ, মহাকাব্য ও সংস্কৃত কাব্য থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে আপন প্রতিভা বলে নতুন করে নবপুরাণ সৃষ্টি করেছেন। মাইকেলের বীরাঙ্গনা কাব্য তেমনই এক সৃষ্টি। সেখানে এগারোজন পৌরাণিক নায়িকা তাঁদের প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে যে পত্র প্রেরণ করেছেন তারই সমবায়ে গড়ে উঠেছে বীরাঙ্গনা কাব্য

মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের কাহিনী যেমন রামায়ণ থেকে গৃহীত। রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনার থেকে উপাদান সংগ্রহ করে আপন সৃজনশীল প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে নব মহাকাব্য রচনায় সমর্থ হয়েছিলেন। বীরাঙ্গনা কাব্যের ক্ষেত্রেও তেমনি বিভিন্ন পুরাণ, মহাকাব্য, প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য এমনকি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের উপাদান গ্রহণ করে আপন প্রতিভা বলে তার নবায়ণ ঘটিয়ে নতুন কাব্য সৃষ্টি করেছিলেন।

মধুসুদনের এই উপাদান সংগ্রহ কার্যক্রম মোটামুটিভাবে তিনটি পর্যায়ে তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। (১) পুরাণ ও মহাকাব্যের অনুকরণ, অনুসরণ বা অনুবর্তন। (২) প্রয়োজনবোধে উপাদান গ্রহণ, বর্জন, সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন। (৩) পৌরাণিক পটভূমিকায় রোমান্টিকতার বাতাবরণ সৃষ্টি করা। এই তিনটি ধারায় কবি মধুসূদন তাঁর কাব্য নির্মাণ কল্পে পৌরাণিক উপাদান গ্রহণ করেছিলেন।

অনুসরণ, অনুবর্তন পর্যায়ে আলোচনা করা যেতে পারে সেই সমস্ত উৎসের কথা যেখান থেকে কবি রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। বলা বাহুল্য পুরাণ বা মহাকাব্যের কোন নায়িকাই তাঁদের নায়কদের কাছে পত্র প্রেরণ করেন নি। পত্র রচনা ও পত্র প্রেরণ সম্পূর্ণতঃ কবি মধুসুদনের চিন্তা ও প্রতিভা প্রসূত। তিনি পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে কেবল উপাদান সংগ্রহ করেছেন। নায়িকাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দানও বহুলাংশে তাঁরই স্বকীয় উদ্ভাবনীর ফল।

শকুন্তলার কাহিনীর উপাদান তিনি গ্রহণ করেছিলেন মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম থেকে কিন্তু কালিদাসের শকুন্তলার সঙ্গে মধুসুদনের শকুন্তলার কিছু মৌলিক প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়—যা কবি মধুসূদনের মৌলিকতার প্রমাণ দান করে। কালিদাসের শকুন্তলা সম্বৃতবাক এবং দুখস্তের সঙ্গে তাঁর প্রণয় পর্বে দুষ্মন্তের প্রেম সভাষণের তিন চতুর্থাংশ উত্তর-প্রত্যুত্তর সংলাপ করেছিল তাঁর দুই প্রিয় সখী অনুসূয়া ও প্রিয়ম্বদা এমনকি বিরহ কাতর অবস্থায় পদ্মপাতায় যে পত্র লেখার ঘটনা অভিজ্ঞান শকুন্তলম এ বর্ণিত হয়েছে, সেখানেও দেখা গেছে অনসূয়া ও প্রিয়ম্বদাই সে পত্র লিখেছেন। কিন্তু মধুসূদনের শকুন্তলা নিজের মনের অবস্থা নিজেই জানাতে পারেন এবং পত্রও তিনি নিজেই একাকী লিখেছেন—

“পদ্মপর্ণ নিয়া

কত যে কি লিখি নিত্য কর তা কেমনে?”

অর্থাৎ বাকপটু না হলেও তিনি নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। হয়তো উচ্চকণ্ঠে নয় কিন্তু মৃদু স্বরের কথাতেও তাঁর প্রিয় সখীদ্বয়ের সাহচর্যের দরকার হয় না।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে তারা চরিত্র গ্রহণ করেছেন মধুসূদন ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকা রচনার সময়। কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে তারা চরিত্র গ্রহণ করলেও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের তারার সঙ্গে মধুসূদনের তারার যথেষ্ট প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। মধুসূদন যে ভাবে তারার চরিত্র চিত্রিত করেছেন তা এক অর্থে পুরাণ বিরোধী বলা যেতে পারে। কেননা, মধুসূদনের তারা প্রেম বুভুক্ষু কামার্তা কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের তারা সাধ্বী রমণী। চন্দ্রের প্রেমাকাঙ্ক্ষার উত্তরে সেখানে শোনা যায় তারার রোষদীপ্ত ভর্ৎসনা বাক্য। পৌরাণিক তারা নিরপরাধা, চন্দ্রের ওবঙ্গনাগমন তুল্য অসদৃশ ব্যবহারে তারা চন্দ্রকে সক্রোধে বলেছেন—

**ত্যজমাং ত্যজমাং চন্দ্ৰ, সুরেষু কুল পাংশুক

গুরুপত্নীং ব্রাহ্মনীঞ্চ, পতিব্রত পরায়ণাং

গুরুপত্নী সঙ্গমাঙ্গ ব্রাহ্মহত্যাশতং লভেং

পুত্রস্তং মাতাহং, ধৈর্যং কুরু সুরেশ্বর।**

এবং এর পরেও তিনি চন্দ্রকে রাহুগ্রস্ত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হবার এবং চন্দ্র দর্শনে পাপ হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু মধুসূদনের তারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত মনস্কা। তিনি ভুলতে চান যে তিনি চন্দ্রের গুরুমাতা। চন্দ্র তাঁকে প্রণাম করলে মনগড়া কল্পনায় সে প্রণামকে প্রেমিকের মানভঞ্জন সাধনা রূপে চিন্তা করতে থাকেন। সর্বোপরি মধুসূদনের তারা ইন্দ্রিয় পরবশ প্রেমের আকাঙ্ক্ষিণী। তাই বীরাঙ্গনার তারা পৌরাণিক চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও মধুসূদনের মৌলিক সৃষ্টি। অনুরূপভাবে কাশীরাম দাসের মহাভারত থেকে গৃহীত দ্রৌপদী চরিত্রেরও যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কাশীরাম দাসের দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীধন্যা হয়েও কর্ণের প্রতি অনুরাগিনী। আর মধুসূদনের দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর মধ্যে কেবলমাত্র অর্জুনের প্রতি একদেশদর্শিতা প্রকাশ করেছেন। অকুণ্ঠে বলেছেন—

“পাঞ্চালীর চিরবাঞ্ছা, পাঞ্চালীর পতি

ধনঞ্জয়; এই জানি, এই মানি মনে।”

জনা চরিত্র মূল মহাভারতে নেই। মধুসূদন এরও উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন কাশীরাম দাসের মহাভারত থেকে।

দশরথের প্রতি কেকয়ী পত্রিকায় পৌরাণিক উপাদানের সংস্কার সাধন এবং সংযোজন করা হয়েছে। দশরথ কেকয়ী সংবাদ রামায়ণে যা আছে সেখানে কেকয়ী বা কৈকেয়ী শ্রীরামচন্দ্রের গুণকীর্তনই করেছেন। রামচন্দ্রের যৌবরাজ্য হিসেবে অভিষিক্ত হবার সংবাদে সানন্দ চিত্তে কৈকেয়ী বলেছেন—

“রাম ধার্মিক তনয়।

কোন দোষে রামের করিব অপচয়।

আমার গৌরব রাম রাখে অতিশয়।

করিতে রামের মন্দ উপযুক্ত নয়।

গুণের সাগর রাম বিচারে পণ্ডিত

পিতৃরাজ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র পাইতে উচিত।।”

কিন্তু মধুসূদনের কেকয়ী রামের প্রতি বৈমাত্রীসুলভ বাক্যবর্ষণই করে গেছেন এবং তাঁর সপত্নী রাম-জননী সম্বন্ধেও শ্রদ্ধেয় মতামত ব্যক্ত করেন নি।

আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় শূর্পণখা চরিত্রের। রামায়ণ থেকে গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও মধুসূদন মানবতাবাদের ধারা প্রবর্তনের কারণেই তাকে রাক্ষসী রূপে চিত্রিতা না করে সুন্দরী অনার্য বাল বিধবা রূপে চিত্রিত করেছেন। ভূমিকায় তিনি সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, “কবিগুরু বাল্মিকী রাজেন্দ্র রাবণের পরিবার বর্গকে প্রায়ই বীভৎস রস দিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এ স্থলে সে রসের লেশমাত্রও নাই। অতএব পাঠকবর্গ সেই বাল্মিকী বর্ণিতা বিকটা শূর্পণখাকে স্মরণ পথ হইতে দূরীস্কৃতা করিবেন।” বস্তুতঃ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে উপাদান গৃহীত হলেও নবভাবে নব পুরাণ সৃষ্টিরই দৃষ্টাও যেন উজ্জ্বলরূপে দেখতে পাওয়া যায়।

এইভাবে দেখা যায়, কবি মধুসূদন পাশ্চাত্য ভাবধারার আদর্শে প্রাণিত হয়ে বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করলেও, পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্য ভাবধারা যেমন তার মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে এর চরিত্র ও কাহিনীর উপাদান গ্রহণ করা হলেও কবির স্বকীয় প্রতিভার কারণে বীরাঙ্গনা কাব্য হয়ে উঠেছে কবি মধুসূদনের মৌলিক সৃষ্টি।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি: সাহিত্যে মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে চিনিয়ে দেওয়া ও তা থেকে মুক্ত করাই ছিল উত্তর-গঠনবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য।  উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ বলতে চিন্তা ও বিশ্লেষণের

Read More
মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি: সাহিত্যকে যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এর ভিত্তিতে বিচার করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে মার্কসীয় সমালোচনা রীতি। এখানে বস্তুবাদ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, এটি বেশ উল্লেখযোগ্য

Read More

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। কতকগুলো গানের সংকলন হলো চর্যাপদ। ‘চর্যাপদ’ একটি বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দ। চর্যাপদ শব্দের অর্থ যা

Read More

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ: রোমান্টিসিজম (Romanticism) সাহিত্যের একটি ধারা, যা মূলত উনবিংশ শতকে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়েছিল। রোমান্টিসিজমের মূল ভাবনা ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম, মানবিক আবেগের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.