জয়দেবের বহু আগে থেকেই প্রাচীন ভারতে প্রেমের আদর্শ নিয়ে কাব্য রচনার একটি ধারা প্রচলিত ছিল। এই প্রেমকাব্যের প্রধান উপজীব্য ছিল রাধা-কৃষ্ণের লীলার গল্প। বিভিন্ন সংস্কৃত এবং প্রাকৃত কবিতায় রাধা-কৃষ্ণের লীলার আভাস পাওয়া যায়। এই ধারার পথ ধরে পদাবলী সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটে, যা জয়দেবের পরবর্তী সময়ে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর বাংলায় বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বা ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’ নামে পালাকীর্তন ভিত্তিক তথ্য-নাট্য-গীতি রচনা করেন।
যদিও বৈষ্ণব পদাবলী মূলত আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত, একসময় তা মুক্ত এবং সর্বজনীন রসের প্রকাশে পরিণত হয়। দেখা যায়, বৈষ্ণব নয় এমন কবিরাও, এমনকি বহু মুসলিম কবিও বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন, যা এর সর্বজনীনতার পরিচায়ক।
বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনায় ছিলেন কবি জয়দেব, যিনি সংস্কৃত ভাষায় ‘গীতগোবিন্দ’ রচনা করেন। এরপর এই ধারা আরও প্রসারিত করে মিথিলার বিদ্যাপতি, যিনি ব্রজবুলিতে রাধা-কৃষ্ণ সম্পর্কিত অসংখ্য স্মরণীয় পদ রচনা করেন। তাঁর পরে আসেন চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ কবিরা, যাঁরা চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক বা পূর্ববর্তী ছিলেন।
বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উপজীব্য প্রেম, যা শৃঙ্গার রসে উদ্ভাসিত। যদিও বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পাঁচটি রসের কথা বলা হয়েছে, তবু শৃঙ্গার রসকেই শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রূপ গোস্বামী শৃঙ্গার রসকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন: বিপ্রলম্ভ এবং সম্ভোগ।
বিপ্রলম্ভ বলতে বোঝায় মিলনের অনুপস্থিতি। নায়ক-নায়িকার মধ্যে অভিমান, আলিঙ্গন বা চুম্বনের অক্ষমতা থেকে যে মানসিক বেদনা জন্ম নেয়, তাকে বিপ্রলম্ভ বলে, যা পরবর্তীতে সম্ভোগের জন্য মাটি প্রস্তুত করে। বিপ্রলম্ভের চারটি পর্যায় রয়েছে: পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্র্য, এবং প্রবাস। এই বিপ্রলম্ভের পরিণতিতে যে মিলন ঘটে, তা আসলে ভাবের জগতে ঘটে এবং এক প্রকার স্বপ্নময়।
শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রেম ধীরে ধীরে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মান, প্রেমবৈচিত্র্য, আত্মসমর্পণ এবং প্রবাসের মতো বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। বৈষ্ণব কবিরা এই ক্রমবিকাশকে তুলে ধরেছেন তাঁদের রচনায়।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের প্রথম সূচনা ঘটে পূর্বরাগে, যেখানে নায়ক-নায়িকা প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই পর্যায়ে রাধা কৃষ্ণের নাম শুনে এবং তাঁর রূপ দেখে মুগ্ধ হন। যেমন, চণ্ডীদাস লিখেছেন:
“সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম? কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মন প্রাণ।”
রাধা-কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলে অনুরাগও বাড়ে। কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রথম আকর্ষণ ও প্রেমানুরাগের উদাহরণ হিসেবে বিদ্যাপতির রচনা উল্লেখযোগ্য:
“যাহা যাহা নিকসয়ে তনু তনু-জ্যোতি, তাহা তাহা বিজুরি চমকময় হোতি।”
পূর্বরাগ ও অনুরাগের পথ পেরিয়ে রাধা অভিমানে কৃষ্ণকে না পাওয়ার কষ্টে মান করেন। এই মানের অবস্থায় নায়িকা নায়কের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং কলহের সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণও মান ভাঙানোর চেষ্টা করেন, এবং শেষপর্যন্ত তাঁদের মিলন ঘটে।
প্রেমের আরেকটি পর্যায়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমবৈচিত্র্য এবং আক্ষেপানুরাগ দেখা দেয়, যেখানে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার পরও মনে বিরহের বেদনা থাকে। চণ্ডীদাসের এক পদে এর উদাহরণ পাওয়া যায়:
“দুই কোরে দুই কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া, আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।”
বিরহের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদের ব্যথা গভীর হয়ে ওঠে, বিশেষত যখন কৃষ্ণ মথুরায় চলে যান এবং রাধার মনে গভীর বিরহের সৃষ্টি হয়। চণ্ডীদাস লিখেছেন:
“এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।”
তবে, বিরহের পরেও মিলন ঘটে, যদিও তা বাস্তবিক নয়, বরং ভাবের জগতে। বিদ্যাপতি রাধার মুখে বলেন:
“আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু, পেখলু পিয়া-মুখ-চন্দা।”
বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রেমকাহিনী, যা রাধা-কৃষ্ণের হৃদয়ের ধীরে ধীরে উন্মোচনের মাধ্যমে অনুভূতির নানা স্তরে বিকশিত হয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেম একদিকে আধ্যাত্মিক, আবার মানবীয় প্রেমেরও একটি অনন্য প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের মতে, এই প্রেমের সঙ্গীত শুধু বৈকুণ্ঠের নয়, মানব হৃদয়েরও।