Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

আধুনিক বাংলা কাব্যে অমিয় চক্রবর্তীর অবদান

কবি অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬) আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তাঁর মরমীয়াবাদের জন্য স্বতন্ত্র। বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে পৃথিবী তখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। এলিয়ট যে যুগকে ‘পড়ো জমি’ প্রতীকে চিহ্নিত করেছেন এবং যার চোখে মানুষরা ‘ফাপা মানুষ’, সেই সময়েই ইউরোপীয় ও এদেশীয় কবিদের কবিতায় প্রতিফলিত হয় ‘মরুভূমি’, ‘চোরাবালি’, ‘ফণিমনসা’, ‘নষ্ট আশা’ ইত্যাদি চিত্রকল্পে। কিন্তু এমন সময়েও অমিয় চক্রবর্তী সহজভাবে শোনাতে পারেন ‘সংগতি’র কবিতা। আধুনিক কবিরা, এমনকি অমিয় চক্রবর্তীর অগ্রজ ও সমকালীনরাও যখন উচ্চকণ্ঠে ঈশ্বরকে অস্বীকার করছেন বা ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করছেন, তখনও একই স্থান-কাল-প্রতিবেশে দাঁড়িয়ে অমিয় চক্রবর্তী হয়ে ওঠেন আধ্যাত্মিক কবি।

বুদ্ধদেব বসু অমিয় চক্রবর্তীকে সম্বন্ধে বলেছিলেন—‘সমকালীন বাংলাদেশের সব চেয়ে আধ্যাত্মিক কবি’। তাঁর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে ঈশ্বরবিশ্বাসের সম্পর্ক নেই; বরং তা জীবনকে অবিরোধী, বিচ্ছেদহীন সুষমরূপে দেখা এবং জীবনের জটিলতাকে ‘হ্যাঁ’-এর অন্তর্ভুক্ত করা। অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন বিশ্বযাত্রী, পশ্চিমী সভ্যতার আলোকে দীপ্ত। দেশের মাটিতেও তিনি ছিলেন গভীর প্রোথিত।

রবীন্দ্রযুগের অমোঘ প্রভাব এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসচিব রূপে তার সান্নিধ্য লাভের কারণে রবীন্দ্রানুসরণ অমিয় চক্রবর্তীর পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। কখনো কখনো রবীন্দ্রিক চিন্তাকেই আধুনিক মূর্তি রূপে তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তবে, রবীন্দ্রিক মরমীয়াবাদের সঙ্গে তাঁর বৈজ্ঞানিক মরমীয়াবাদের অনেক পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রপ্রভাবের অনিবার্যতাকে তিনি নিজের প্রজ্ঞায় অতিক্রম করে নিজেকে স্বতন্ত্রতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার বা অবহেলা করেননি, বরং ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ করেছেন। তাঁর সাহিত্যজ্ঞান, বিশ্বপরিক্রমা ও বিজ্ঞানকে মঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত করার মানসিকতা তাঁকে নেতিবাদী দর্শনের দিকে ঠেলে দেয়নি। বরং আধুনিক কবিদের মধ্যে আশ্চর্যভাবে তিনি বলিষ্ঠভাবে অস্তিবাদী দর্শনকেই কবিতায় উপস্থিত করেছেন।

১৯২৭ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যসাধনার সূচনা হয়। তবে ১৯৩০ পর্যন্ত তাঁর কবিতা প্রধানত রবীন্দ্রানুসরণশীল ছিল। উত্তর-তিরিশে তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্রের সূচনা হয় এবং ১৯৩৮ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খসড়া’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আধুনিক কবিগোষ্ঠীতে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। এরপর তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘একমুঠো’ (১৯৩৯), ‘মাটির দেওয়াল’ (১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ (১৯৪৩), ‘দূরযানী’ (১৯৪৪), ‘পারাপার’ (১৯৫৩), ‘পালাবদল’ (১৯৫৫), ‘ঘরে ফেরার দিন’ (১৯৬১), ‘হারানো অর্কিড’ (১৯৬৬), ‘পুষ্পিত ইমেজ’ (১৯৬৭), ‘অমরাবতী’ (১৯৭২), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭৩), ‘অনিঃশেষ’ (১৯৭৬), ‘নতুন কবিতা’ (১৯৮০) প্রভৃতি। ১৯৬৩ সালে ‘ঘরে ফেরার দিন’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি একাদেমী পুরস্কার লাভ করেন।

‘খসড়া’ ও ‘একমুঠো’ যুগে তিনি তরল রোমান্টিকতা পরিহার করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের মিস্টিক চেতনার থেকে পার্থক্য করে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানচেতনায় দৃঢ়ভাবে যুক্ত। রবীন্দ্রনাথ যেখানে অতীন্দ্রিয় ভাবলকে আশ্রয় নেন, অমিয় চক্রবর্তী সেখানে বাস্তবের অসুন্দরকে গ্রহণ করে সুন্দরকে অনুভব করেন।

‘একমুঠো’র বিখ্যাত কবিতা ‘চেতন স্যাকরা’তে কবি নিম্নমধ্যবিত্ত যুবসমাজের ক্ষয়িষ্ণুতার প্রতীক রচনা করেছেন। একইভাবে ‘দূরযানী’ কাব্যগ্রন্থের ‘মানুষের ঈশ্বর’ কবিতায় তিনি শ্রেণীবৈষম্যের প্রতি কটাক্ষ করেছেন।

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় কখনো অন্য কবির প্রতিধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু উপস্থাপনায় সেই উচ্চারণই আধুনিক। আধুনিক যুগের রূঢ় বাস্তবতাকে অস্বীকার না করেও অমিয় চক্রবর্তী কবিতার মাধ্যমে ঘর বাঁধার এক অনড় বিশ্বাসের স্বপ্ন দেখাতে পারার জন্য বিশেষ পরিচিত—

‘হয়তো তীরে বাড়ি নেই, তবু ভরসায়
ভালোবাসা পায় ঘর।’

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.