Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

বাংলা কবিতায় মোহিতলাল মজুমদারের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

মোহিতলাল, নজরুল, এবং যতীন্দ্রনাথ—এই তিন কবি রবীন্দ্রযুগে বিকশিত হয়েছেন, রবীন্দ্র সাহিত্য ও ভাবনা থেকে প্রভাবিত হয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিন্তার মৌলিকতায় রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং দীপ্তি নিয়ে বাংলা কাব্যক্ষেত্রে উজ্জ্বল চিহ্ন রেখে গেছেন।

কবি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) একাধারে কবি এবং সমালোচক ছিলেন। জীবন এবং কাব্য সম্পর্কিত তার বিশেষ কিছু ক্লাসিক ধারণা ছিল। কাব্য, জীবন, এবং কাব্যবিচার—তিনটি ক্ষেত্রেই তার দর্শন ছিল একত্রিত। বাস্তব প্রয়োজনে তিনি কখনো তার সারস্বতিক ধারণা বিসর্জন দেননি। সমালোচনায়ও তিনি ছিলেন নির্ভীক ও অকপট। বাংলা কবিতার তরল রসায়নে তিনি ক্লাসিক শক্তি ও দৃঢ়তা সঞ্চারের জন্য চিরকাল সচেষ্ট ছিলেন।

ভারতী গোষ্ঠীর অন্যান্য কবিদের মতো মোহিতলালও রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তার প্রথম দিকের কবিতা সেই রবীন্দ্রানুসরণকে সাক্ষ্য দেয়। সত্যসুন্দর দাস ছদ্মনাম গ্রহণও এই রবীন্দ্র-অনুরাগের প্রমাণ। কিন্তু মৌলিক কাব্যচিন্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর রবীন্দ্রকাব্যের ভাবের বিলাস, অপ্রাকৃত প্রেম এবং সবগ্রাসী রচনাশৈলী গ্রহণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের অশরীরী প্রেমের কল্পনাকে অস্বীকার করে তিনি তান্ত্রিকের মতো উচ্চকণ্ঠে ইন্দ্রিয়ের স্তবগান গাইলেন—

“কাচের পেয়ালা ভেঙে ফেল তোরা, লওরে অধরে তুলি,

শ্মশানের মাটি লাগিয়াছে গায়-মড়ার মাথার খুলি।

ভাবে বুদ হয়ে, বুদবুদে ভরা,

কামনার রঙে রাঙা রঙ করা,

নীর নাহি যায়—বহ্নির প্রায় সুরায় পড় গাে ঢুলি;

টিটকারী দাও মৃত্যুরে, লও মড়ার মাথার খুলি।”

রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতার মধ্যে বাস্তব-অবাস্তবের পার্থক্য সবসময় স্পষ্ট নয়, কিন্তু মোহিতলালের রোমান্টিকতা বাস্তব নির্ভর। রবীন্দ্রনাথের মতো মোহিতলালের মানসলক্ষ্মীও বাস্তবের সাথে সংযুক্ত হলেও, বাস্তবের বাহু পাশে ধরা না দিলেও তার সংযোগ কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি। রবীন্দ্রনাথ দেহাতীত প্রেমে বিশ্বাসী। তার মতে—

‘আকাঙক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।’

কিন্তু মোহিতলালের কবিতায় দেহের প্রতি উদগ্র আকর্ষণ বারংবার প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় দর্শন অনুসারে আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসী। মৃত্যুর মাধ্যমে জীবন প্রবাহের শুচিতারক্ষার তত্ত্বে তার আস্থা। কিন্তু মোহিতলাল স্পষ্টত দেহবাদী কবি। তার জীবনবাদ শরীরের মধ্য থেকেই উৎসারিত। ‘মৃত্যুশোক’ কবিতায় দেহের জন্য তার আর্তনাদ শোনা যায়—

‘যাহারে হারাই তারি তরে হিয়া আরাে করে হায় হায়,

স্মৃতি সুখ উথলায়।’

মন্দিরের দেবতা যেহেতু দেহের দেউল’ নিবাসী দেবতার অপমান করেছে, অতএব সেই অপমানের যোগ্য প্রতিশোধ নিয়েছে কালাপাহাড়। কবিকণ্ঠে সেই কালাপাহাড়ের ভাঙনের উল্লাস উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হয়েছে—

“ভেঙে ফেল মঠ-মন্দির চূড়া, দারুশিলা কর নিমগুণ।

বলি-উপচার ধূপ-দীপারতি রসাতলে দাও বিসর্জন।

নাই ব্রাহ্মণ ম্লেচ্ছ যবন, নাই ভগবান-ভক্ত নাই

যুগে যুগে শুধু মানুষ আছেরে! মানুষের বুকে রক্ত চাই!

ছাড়ি লোকালয় দেবতা পালায় সাত-সাগরের সীমানা পার।

ভয়ঙ্করের ভয় ভেঙে যায়, বাজায় দামামা, কাড়া-নাকার;”

এ পর্যন্ত বাংলার কাব্যসাধনা বৈষ্ণবীয় রসসাধনার আবর্তে অথবা রবীন্দ্রচেতনালব্ধ ঔপনিষদিক সীমা-অসীমের তত্ত্বের আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে। মোহিতলাল সেই আধ্যাত্মার্গ ও ঔপনিষদিক দর্শনের পথে এসে বলিষ্ঠ জীবনের মধ্যে দেহকামনার কল্পনাকে প্রবাহিত করেছেন। পূর্বে ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্রের স্থল দেহভাবনাকেই তিনি সূক্ষ্ম রসবিলাসে পরিণত করেছেন।

মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’। এটি কবি-আত্মীয় দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশংসামূলক ১৬টি মাত্র সনেটের সংকলন। এছাড়া রয়েছে—’স্বপন পসারী’ (১৯২১), ‘বিস্মরণী’ (১৯২৬), ‘স্মরগরল’ (১৯৩৬), ‘হেমন্ত গোধূলি’ (১৯৪১)। আসলে ‘স্বপন পসারী’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই মোহিতলালের স্বাতন্ত্র ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়েছে।

১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দ থেকেই প্রথম মোহিতলালকে অন্তত কয়েকটি কবিতায় স্বতন্ত্র সত্তায় চিনে নেওয়া যায়। এই সময় মোসলেম ভারত পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা রচনার ফলে ভারতী পত্রিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯২৩ নাগাদ তিনি ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ইতিমধ্যে ‘স্বপন পসারী’ প্রকাশের ফলে কবিতাপ্রিয় যুবসমাজের কাছে তিনি আধুনিক স্বাতন্ত্র চিহ্নিত কবি হিসেবে পরিচিত হন। ‘সাহিত্যে নবত্ব’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী পত্রিকায় কবি মোহিতলাল সম্পর্কে সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন—

‘পৌরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই,

শক্তির মর্যাদা আছে; সাহস আছে,

বাহাদুরি নেই।’

মোহিতলালের কবিতায় সেই পৌরুষের বলিষ্ঠ সাহসিকতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বপন-পসারী’ কাব্যগ্রন্থে এরকম কয়েকটি বলিষ্ঠ কবিতা ‘অঘোরপন্থী’, ‘নাদির শাহের জাগরণ’, ‘বেদুইন’, ‘পাপ’ ইত্যাদি।

‘অঘোরপন্থী’ কবিতায় কবি নিজ কবিধর্মকে অঘোরপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে দেহাত্মবাদের জয় ঘোষণা করেছেন। জীবনের রস-রূপ যতদিন আছে, ততদিন মৃত্যুভয়ের জন্য জীবন-রস সম্ভোগ থেকে তিনি নিবৃত্ত হতে চান না—

‘জীবন মধুর! মরণ নিঠুর-তাহারে দলিব পায়।

যতদিন আছে মোহের মদির ধরণীর পেয়ালায়।’

অঘোরপন্থীদের মতো তিনি সদা মদমত্ত থাকার পক্ষপাতী, খাদ্যাখাদ্য ব্যাপারে ঘৃণাহীন এবং যাবতীয় সংস্কার মুক্ত। ‘পাপ’ কবিতাতেও মোহিতলালের ভোগবাদী রূপ প্রকাশিত—

‘ত্যাগ নহে ভোগ, ভোগ তারি লাগি, যেইজন বলীয়ান।

নিঃশেষে ভরি লইবারে পারে এত বড় যার প্রাণ।’

‘বিস্মরণী’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মোহিতলালের কবিখ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ে। ‘বিস্মরণী’ ও পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘স্মরগরল’ মোহিতলালের বলিষ্ঠ জীবনচেতনার পরিচায়ক। ‘বিস্মরণী’র ‘পান্থ’ কবিতায় মোহিতলাল সোপেনহাওয়ারের নারী বিদ্বেষী দর্শনকে অস্বীকার করেছেন দৃপ্তকণ্ঠে। ‘বুদ্ধ’ কবিতায় কবি আক্রমণ করেছেন গৌতম বুদ্ধকে। কেননা মানুষের জরা, ব্যাধি-মৃত্যুর বেদনায় অস্থির হয়ে গৃহত্যাগ করে তিনি মানুষকে পার্থিব এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। অথচ এ সাধনায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন অবিতর্কিতভাবে। ‘স্মরগরল’ কবিতায় নিজ দেহাত্মবাদের স্বরূপ উন্মোচিত করে কবি লিখেছেন—

‘মোর কাম কলা-কেলি উল্লাস

নহে মিলনের মিথুন-বিলাস,’

এরপর কবি মোহিতলাল বাংলার আধুনিক কাব্যজীবনে পরিণত হয়ে বিদায় নিয়েছেন।

তবে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও মোহিতলালের কাব্য-ভাষায় প্রচলিত বাংলা কবিতার রবীন্দ্রপ্রভাবের সাথে যেহেতু গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাই মোহিতলালের কবিতা পর্যালোচনায় রবীন্দ্রপ্রভাব চিহ্নিত করার জন্য লক্ষণীয় বিষয় হলো, কবির ভাবনায় কাব্যজীবন চর্চায় কোনও ভাবেই রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক বাংলার সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ রবীন্দ্রনাথ। মোহিতলাল আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি, তিনি রবীন্দ্রভাবনা থেকে বেরিয়ে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন, যার জন্য তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি এখনও সমাদৃত।

প্রতিটি কবি তার যুগের অবস্থান জানিয়ে দেন এবং তার কাব্যও হয় যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণযোগ্য। মোহিতলালের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। তার কাব্যশৈলী এবং দর্শন রবীন্দ্রযুগের সাহিত্য পরিমণ্ডলে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

কাজী ইমদাদুল হক এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

কাজী ইমদাদুল হক (৪ নভেম্বর ১৮৮২ – ২০ মার্চ ১৯২৬) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, এবং সমাজকর্মী। তার সাহিত্যকর্ম এবং শিক্ষাবিষয়ক অবদানের

Read More

কাজী মোতাহার হোসেন এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই, ১৮৯৭ – ৯ অক্টোবর, ১৯৮১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা

Read More

ধ্বনিবিজ্ঞান কী বা ধ্বনিবিজ্ঞান কাকে বলে? ধ্বনিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও!

ধ্বনিবিজ্ঞান: ধ্বনিবিজ্ঞান হচ্ছে বাক্ ধ্বনির বিশ্লেষণ। বাগ্‌ধ্বনি সম্পর্কে পঠন-পাঠনকে বলা হয় ‘ধ্বনিবিজ্ঞান’। The science, study, analysis and classification of sounds, including the study of their

Read More

ধ্বনিবিজ্ঞান কী? ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বের পারস্পারিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর!

ধ্বনিবিজ্ঞান হচ্ছে বাক ধ্বনির বিশ্লেষণ। The science, study, analysis and classification of sounds, including the study of their production, transmission and perception. অপরদিকে ধ্বনিতত্ত্ব হলো

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.