Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা সাহিত্যের বিকাশে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অবদান

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জীবনী এবং প্রারম্ভিক অবদান

বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার প্রসার এবং সমাজ সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী মনীষী হিসেবে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তাঁর সামগ্রিক অবদান বিজ্ঞানের জগৎ, সমাজসংস্কার, এবং শিক্ষার প্রসারেও সমানভাবে প্রসিদ্ধ। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়, যদিও তাঁর কাজ কেবল প্রবন্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

রামেন্দ্রসুন্দর রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় এম. এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অধ্যাপনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানবৃত্তির প্রতিফলন পাওয়া যায় সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে। বর্ণব্যবস্থার সংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন—এ সব ক্ষেত্রেই তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সাহিত্য অবদান

যদিও তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, রামেন্দ্রসুন্দর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর সাহিত্যকর্মে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং নানাবিধ জ্ঞানের বিষয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়েছে। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলিতে গভীর দার্শনিকতা ও বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতার প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন তাঁর “প্রকৃতি”, “জিজ্ঞাসা”, “কর্মকথা” ইত্যাদি গ্রন্থগুলিতে বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে।

তাঁর প্রবন্ধগুলি প্রায়ই কঠিন বিষয় নিয়ে রচিত হওয়ায় অনেক সময়ই সেগুলি সাধারণ পাঠকদের জন্য কঠিনপ্রবেশ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু বিষয়ের জটিলতা বোঝা সত্ত্বেও, তিনি সহজ ভাষায় সেই জটিল তত্ত্বগুলি ব্যাখ্যা করেছেন এবং শিক্ষিত সমাজের মধ্যে চিন্তার উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে তাঁর বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোতে জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন জ্ঞান সহজভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

‘প্রকৃতি’ এবং বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘প্রকৃতি’ (১৮৯৬) বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানচিন্তার এক নতুন ধারার সূচনা করেছিল। বইটিতে সৌরজগতের উৎপত্তি, পৃথিবীর বয়স, আকাশতরঙ্গ প্রভৃতি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ প্রবন্ধগুলোতে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন মৌলিক তত্ত্ব সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচিন্তার প্রসারের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি অনন্য ভূমিকা পালন করে।

‘প্রকৃতি’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে প্রায় এককভাবে বিজ্ঞানচিন্তার বীজ রোপণ করেছিল। এতে তিনি কোনও মৌলিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেননি, কিন্তু পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের তত্ত্বগুলোকে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলেছেন। তাঁর কাজ ছিল জ্ঞানের সেতুবন্ধন করা, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।

‘জিজ্ঞাসা’ এবং দার্শনিক বিশ্লেষণ

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘জিজ্ঞাসা’ (১৯০৪)। এটি একটি গভীর দর্শনমূলক গ্রন্থ, যেখানে তিনি জীবন, জগত, আত্মা, মুক্তি প্রভৃতি জটিল বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘সুখ না দুঃখ’, ‘জগতের অস্তিত্ব’, ‘আত্মার অবিনাশিতা’, ‘মুক্তি’ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলি তাঁর দর্শনবোধের গভীরতা এবং জীবনের রহস্য নিয়ে তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধানের পরিচয় দেয়। তিনি ডারউইনের নির্বাচনতত্ত্বকেও সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন, যা সেই সময়ের জন্য খুবই ব্যতিক্রমী ছিল।

‘জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে দার্শনিক প্রবন্ধের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তিনি সত্য, অতিপ্রাকৃত, মাধ্যাকর্ষণ, এবং নিয়মের রাজত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন, যা সেই সময়ের বাংলা সাহিত্যে ছিল এক অভিনব সংযোজন।

সমাজসংস্কার ও ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অন্যতম বিখ্যাত রচনা ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ (১৯০৬)। এটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিবাদে রচিত একটি সাহসী রচনা। এর মাধ্যমে তিনি দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য, সংহতি এবং দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। রচনাটি চলিত ভাষায় রচিত হওয়ায় তা সহজেই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়।

বঙ্গভঙ্গের সময় বাংলার সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে রচিত এই ব্রতকথাটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এর মাধ্যমে রামেন্দ্রসুন্দর একাধারে সাহিত্যকর্মী এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান “বাংলার মাটি, বাংলার জল” এই রচনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা সারা দেশে মানুষের মধ্যে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিল।

‘চরিতকথা’ এবং নৈতিক শিক্ষার প্রচেষ্টা

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘চরিতকথা’ গ্রন্থটি নৈতিক শিক্ষা প্রসারে তাঁর বিশেষ ভূমিকার পরিচয় দেয়। এই গ্রন্থে তিনি দেশবিদেশের বিভিন্ন মনীষীর জীবনী তুলে ধরেছেন, যাতে যুবসমাজ তাদের আদর্শ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে। গ্রন্থটির মধ্যে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’, এবং ‘হেলমহোলজ’ প্রভৃতি মনীষীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এ গ্রন্থে যুবসমাজকে নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সমাজের উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন যুবসমাজ সঠিক আদর্শ অনুসরণ করবে। তাই ‘চরিতকথা’ গ্রন্থটি শুধুমাত্র জীবনীগ্রন্থ নয়, এটি ছিল নৈতিক শিক্ষার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

‘শব্দকথা’ এবং ভাষার উন্নয়ন

বাংলা ভাষা এবং ব্যাকরণ সম্পর্কিত তাঁর রচনা ‘শব্দকথা’ গ্রন্থে ভাষা বিষয়ক নানান জটিল বিষয়কেও সহজবোধ্য করে তোলার প্রয়াস দেখা যায়। ‘ধ্বনিবিচার’, ‘বাংলা ব্যাকরণ’, এবং ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা’ প্রভৃতি প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি ভাষার সৌন্দর্য এবং তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা ভাষার বিকাশে যে অবদান রেখেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার শুদ্ধতা এবং ব্যবহারিকতার উপর জোর দিয়েছেন।

‘যজ্ঞকথা’ এবং প্রাচীন শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রাচীন শাস্ত্র বিষয়ক জ্ঞানও ছিল অসাধারণ। তাঁর রচিত ‘যজ্ঞকথা’ গ্রন্থে বৈদিক যাগযজ্ঞের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। এতে তিনি বৈদিক যুগের সমাজের চিত্রকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর অন্যান্য রচনায়ও প্রাচীন শাস্ত্রের গভীর প্রভাব দেখা যায়।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সাহিত্য এবং সামাজিক অবদান বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর রচনাবলী কেবলমাত্র সাহিত্যকর্ম নয়, তা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিতে এক মূল্যবান সংযোজন। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি: সাহিত্যে মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে চিনিয়ে দেওয়া ও তা থেকে মুক্ত করাই ছিল উত্তর-গঠনবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য।  উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ বলতে চিন্তা ও বিশ্লেষণের

Read More
মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি: সাহিত্যকে যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এর ভিত্তিতে বিচার করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে মার্কসীয় সমালোচনা রীতি। এখানে বস্তুবাদ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, এটি বেশ উল্লেখযোগ্য

Read More

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। কতকগুলো গানের সংকলন হলো চর্যাপদ। ‘চর্যাপদ’ একটি বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দ। চর্যাপদ শব্দের অর্থ যা

Read More

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ: রোমান্টিসিজম (Romanticism) সাহিত্যের একটি ধারা, যা মূলত উনবিংশ শতকে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়েছিল। রোমান্টিসিজমের মূল ভাবনা ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম, মানবিক আবেগের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.