Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা সাহিত্য জগতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। মূলত উপন্যাস লেখক হিসেবে তিনি সুবিখ্যাত, তবে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যও একইভাবে বাংলা ভাষার অন্যতম রত্ন। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অনস্বীকার্য, কারণ তিনি কেবল প্রবন্ধ রচনায় নিজস্ব দক্ষতা দেখাননি, বরং সমালোচনামূলক চিন্তাধারারও প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলো বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, ভাষার নিপুণতা এবং চিন্তার গভীরতার জন্য আজও প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধে আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদান, তাঁর চিন্তার দিক এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অসামান্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

১. প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমের স্থান ও প্রভাব

প্রবন্ধ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধসমূহ বাংলা ভাষার গভীরতা ও ঋজুতার একটি শক্তিশালী উদাহরণ। তাঁর লেখা কেবল একটি বিষয়কে উপস্থাপন করেনি, বরং সেই বিষয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা এবং সেসবের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই সময়ের পাঠকসমাজে আলোড়ন তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক প্রতিভাকে এককভাবে দায়ী করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দ্রুত বিকাশের জন্য। তিনি লিখেছিলেন, “রচনা এবং সমালােচনা এই উভয় কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্ত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।” বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সময়ে সাহিত্যিক রচনায় এক নতুন মাপকাঠি স্থাপন করেছিলেন, যেখানে লেখকরা শুধুমাত্র রচনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং সমালোচনার মধ্য দিয়েও নতুন সাহিত্যিক আদর্শ প্রচার করেছিলেন।

২. বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের শ্রেণীবিভাগ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধসমূহকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:

  1. জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রবন্ধ
  2. সাহিত্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ
  3. ধর্ম ও দর্শন-সম্পর্কিত রচনা
  4. ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসমূলক রচনা

প্রতিটি বিভাগে তাঁর কাজের মৌলিকত্ব এবং চিন্তার গভীরতা বিদ্যমান। নিচে প্রতিটি বিভাগের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

২.১ জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রবন্ধ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তাভাবনা এবং রচনার বিশাল অংশ বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের উপর কেন্দ্রীভূত। তাঁর বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধগুলোতে তৎকালীন আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর প্রতি আকর্ষণ স্পষ্ট। ‘বিজ্ঞান রহস্য’ (১৮৭৫) এবং ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮৭ ও ১৮৯৩) শিরোনামে তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধগুলোতে বঙ্কিমচন্দ্র টিণ্ডল, হক্সলি, এবং লায়েলের মতো পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের চিন্তাকে আত্মস্থ করে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনর্নির্মাণ করেছেন। তিনি সরাসরি তাঁদের লেখা অনুবাদ না করে, মূল বিষয়গুলির উপর নিজের মননশীলতা প্রয়োগ করেন।

বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল এবং তিনি তৎকালীন সমাজে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব জাগাতে সচেষ্ট ছিলেন। বঙ্গদর্শনের বিভিন্ন সংখ্যায় বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাধারণ পাঠকদের বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। ‘বিজ্ঞান রহস্য’ গ্রন্থটি তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ। বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, ভারতের প্রগতি ও উন্নতির জন্য বিজ্ঞান-শিক্ষা অপরিহার্য।

২.২ সাহিত্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সাহিত্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো তাঁর সাহিত্য-সমালোচনামূলক রচনা। তিনি তাঁর প্রবন্ধগুলির মাধ্যমে সাহিত্যিক মান নির্ধারণের নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। তিনি সমসাময়িক সাহিত্যের উন্নতি এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন নিয়ে গভীর মনোযোগী ছিলেন। এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘উত্তর-চরিত’, ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’, ‘শকুন্তলা’, এবং ‘মিরন্দা ও দেসদিমােনা’। এসব প্রবন্ধে তিনি দেশীয় এবং বিদেশীয় সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চিরায়ত এবং সমসাময়িক সাহিত্যকে বিচার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করতেন যে, কোনো সাহিত্যকর্মের মূল মূল্যায়ন তার চিরায়ত শক্তির ওপর নির্ভর করে। তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোতেও এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়।

২.৩ ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কিত রচনা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ধর্ম ও দর্শনচিন্তার গভীরতা তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৯২) এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮) গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ভারতীয় ধর্ম এবং পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য দর্শন, বিশেষত জেরেমি বেন্থাম এবং আগস্ট কোতের মতবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হিন্দু ধর্মের গূঢ়তত্ত্বে আকৃষ্ট হন এবং সেই ধর্মীয় চিন্তাকে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন।

‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে একটি মানবিক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে অলৌকিকতা কমিয়ে যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাঁর মহত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। কৃষ্ণচরিত্রের অলৌকিকতা ছেঁটে তাঁকে মানবিক আকার দেওয়ার চেষ্টা বঙ্কিমের চিন্তার মৌলিকত্বকে নির্দেশ করে। ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে তিনি মানুষের মনুষ্যত্বের সন্ধান করেছেন, যেখানে মনুষ্যত্বই ধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে।

২.৪ ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক রচনা

বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের একটি চমকপ্রদ শাখা হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যঙ্গাত্মক এবং হাস্যরসমূলক রচনা। এই রচনাগুলোতে তাঁর লেখনীর আরও এক ভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪), ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৭৫), এবং ‘মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ (১৮৮৪) এই রচনাগুলোর মধ্যে বাঙালি জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতি এবং হাস্যকর পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের হাস্যরস বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারা থেকে অনেকটাই পৃথক। তিনি অশ্লীলতা ও ভাঁড়ামির পরিবর্তে সত্যিকারের হাস্যরসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ তাঁর শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক রচনা, যেখানে সমাজের বিভিন্ন দিক এবং চরিত্রকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মদ্যপ এবং অর্ধ উন্মাদ কমলাকান্তের চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে বিদ্রুপ করেছেন, যা পাঠককে হাস্যকর মনে হলেও মূলত একটি গভীর চিন্তার প্রতিফলন।

৩. বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্য ভাষার উন্নয়ন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্য সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। তাঁর গদ্যশৈলী সরল, গতিশীল, এবং পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো। তিনি বিদ্যাসাগরের বর্ণনামূলক গদ্যশৈলীকে অনুসরণ করলেও নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র শৈলী তৈরি করেন। তাঁর গদ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার প্রাঞ্জলতা এবং বাক্যের সুষ্ঠু গঠন।

বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বাক্যের গঠন সহজ, গতিশীল এবং ছন্দময়, যা বাংলা ভাষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি: সাহিত্যে মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে চিনিয়ে দেওয়া ও তা থেকে মুক্ত করাই ছিল উত্তর-গঠনবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য।  উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ বলতে চিন্তা ও বিশ্লেষণের

Read More
মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি বা পদ্ধতি বলতে কী বোঝ?

মার্কসবাদী রীতি: সাহিত্যকে যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এর ভিত্তিতে বিচার করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে মার্কসীয় সমালোচনা রীতি। এখানে বস্তুবাদ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, এটি বেশ উল্লেখযোগ্য

Read More

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর

চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা কর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। কতকগুলো গানের সংকলন হলো চর্যাপদ। ‘চর্যাপদ’ একটি বৌদ্ধ পারিভাষিক শব্দ। চর্যাপদ শব্দের অর্থ যা

Read More

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ

রোমান্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ: রোমান্টিসিজম (Romanticism) সাহিত্যের একটি ধারা, যা মূলত উনবিংশ শতকে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়েছিল। রোমান্টিসিজমের মূল ভাবনা ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম, মানবিক আবেগের

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.