খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় গোটা ভারতের রাজনৈতিক আকাশ ঘনঘটার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। বাদশা ঔরঙ্গজীবের মৃত্যু (১৭০৭ খ্রিঃ) বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশকেও অস্থির করে তোলে। ১৭১৬ খ্রিঃ মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবেদারি লাভ করে দেশে কিছুটা শাসন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। মুর্শিদকুলি খাঁর কোনো পুত্র-সন্তান না থাকায় ১৭২৭ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পর জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার সিংহাসনের অধিকারী হন। তিনি শেষ জীবনে বিলাস-ব্যসনে আসক্ত হয়ে উঠেন। ১৭৩৯ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ খাঁ পিতার উত্তরাধিকারী হন। উচ্ছল হয়ে ওঠার কারণে আমীর-ওমরাহ, জমিদার, দেশি ও বিদেশি বণিক সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। ১৭৪০ খ্রিঃ প্রধান কর্মচারী আলিবর্দি খাঁ বিশ্বাসঘাতকতা করে সরফরাজ খাঁকে হত্যা করে বাংলার মসনদ অধিকার করেন। আলিবর্দি খাঁর রাজত্বকালে ১৭৪২ খ্রিঃ থেকে ১৭৫১ খ্রিঃ পর্যন্ত মারাঠা বর্গীদের অত্যাচারে সারা বাংলা জুড়ে এক সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। ১৭৫৬ খ্রিঃ নবাব আলিবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র নবীন যুবক সিরাজদ্দৌলা বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন, তবে নবাব আলিবর্দির প্রধান কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতায় এবং ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতায় ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত ও নিহত হন। এইভাবে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক ইংরেজ বণিক-কোমপানির অঙ্গুলিহেলনে কিছু কিছু নামেমাত্র নবাবী থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে দেশ শাসিত হতে থাকে ওই বণিকদের দ্বারাই। গোটা অষ্টাদশ শতক জুড়ে বিদেশি বণিকদের লোভ-লালসা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে সমগ্র বাংলাদেশে অত্যাচার ও শোষণের বন্যা বইয়ে দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক ইংরেজ বণিক কোম্পানিই শুধু নয়, ফরাসি, পর্তুগিজ, ডেনিশ এবং ওলন্দাজ বণিকরাও তখন আখের গোছাবার তালে ছিল।
অষ্টাদশ শতকের এই সামগ্রিক অবক্ষয়ের মধ্যেও সারা দেশে একটি মাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র সাহিত্যের আকাশে দীপ্তিমান হয়ে উঠেছিল—এই নক্ষত্রটি হল মধ্যযুগের শেষ এবং সক্ষম প্রতিনিধি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। ১৭৬০ খ্রিঃ ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যে শতাব্দীকাল ধরে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিভার দেখা মিলছিল না। পলাশীর যুদ্ধ এবং ভারতচন্দ্রের মৃত্যু কালের দিক থেকে যুক্ত, যা ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়। এ থেকেই শুরু হলো যুগসন্ধি কাল বা ক্রান্তিকাল। ভারতচন্দ্র ছিলেন যুগসন্ধিক্ষণের কবি যার মধ্যে প্রাচীন ও নবীন যুগের বিভিন্ন লক্ষণের একত্র সমাবেশ ঘটেছিল।
বাংলার বুকে ইংরেজ বণিক কোম্পানির শাসন চলেছিল শতাব্দীকাল ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত। এই বণিক কোম্পানির শাসনকালই বাস্তবে বাংলার যুগসন্ধিকাল—ভাঙাগড়ার কাল। সিপাহি বিদ্রোহের পর বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় সমসাময়িক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থাপক ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের হাতে। ঘটনা হিসেবে ঠিক সেই সময়েই বাংলা দেশে ঘটে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রেনেসাঁস বা নবজাগরণ। কয়েকটি তারিখ দেখা যাক—১৮৫৮ খ্রিঃ যুগসন্ধি কালের শেষ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু এবং একালের প্রথম কবি রঙ্গলালের সাহিত্য জগতে আবির্ভাব; ১৮৬০ খ্রিঃ মাইকেল মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনা; ১৮৬১ খ্রিঃ প্রথম আধুনিক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্যের’ সৃষ্টি এবং রবীন্দ্রনাথের জন্ম।
সমগ্র যুগসন্ধিকাল অর্থাৎ পূর্বোক্ত শতাব্দীকাল জুড়ে বাংলা সাহিত্যের আসর জাঁকিয়ে বসেছিল কবি, যাত্রা, তরজা, পাঁচালী, খেউড়, আখড়াই প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত নিম্নরুচির সাহিত্যকীর্তি।
অষ্টাদশ শতকের শেষ বছরটি অর্থাৎ ১৮০০ খ্রিঃ নানা কারণেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অতিশয় উল্লেখযোগ্য তারিখ। ঐ বছরেই শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশন ও মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। বাংলা গদ্য সাহিত্য রচনার ইতিহাসে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মহৎ দানকে কোনো ক্রমেই উপেক্ষা করা চলে না। মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং গদ্য রচনা প্রচেষ্টার সম্মেলনে সংবাদপত্রের সহায়তায় যুগান্তরকালে ভবিষ্যৎ সাহিত্য, সংস্কৃতির উৎকর্ষের পথ তৈরি হয়ে চলছিল।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্টির কিছুদিন পরে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হলে দেশীয় সন্তানদেরও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়। ডিরোজিও, রিচার্ডসন-আদি মহৎ শিক্ষকদের কাছ থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করে Young Bengal বা নব্যবঙ্গীয় যুব সম্প্রদায় দেশে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের পথ তৈরি করে দেন। এরই প্রত্যক্ষ ফল বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের সৃষ্টিকাল থেকেই এক হিসেবে আধুনিক যুগের আরম্ভ, কারণ এ যুগের সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা—গদ্যসাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা এখান থেকেই। কিন্তু মানসিকতার বিচারে এই পর্বে আধুনিকতার উদ্ভব ঘটেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এ কালের বিভিন্ন কবিওয়ালা, তর্জাওয়ালা প্রভৃতির রচনায়, এমনকি ঈশ্বর গুপ্তের রচনায়ও। বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু ও রঙ্গলাল-মধুসূদনের আবির্ভাবকাল থেকেই আধুনিক যুগ সূচিত হয়ে থাকে।