বাংলা প্রবন্ধ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্যকে নতুন শিল্পমূর্তি প্রদান করেছেন। তাঁর হাতেই বাংলা গদ্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রূপ লাভ করে। পূর্ববর্তী গদ্য শিল্পীরা বাংলা গদ্যের ভাষা নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু বঙ্কিম তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বাংলা গদ্যকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেন। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বাংলা গদ্য চিন্তাজগৎ ও ভাবজগতে বিস্তৃত সুযোগ লাভ করে।
১৮৭২ সালে ‘কাঁদের্শন’ সম্পাদনার পর তিনি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ রচনায় সাড়ম্বরে আবির্ভূত হন। তাঁর প্রবন্ধাবলীর মধ্যে সমাজ, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রচেতনা সম্পর্কিত নানা বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো মননশীলতা, মুক্ত চিন্তার তীক্ষ্ণতা, এবং বক্তব্য বিষয়কে সরসভাবে উপস্থাপনের দুর্লভ ক্ষমতা। উনিশ শতাব্দীর বাঙালী চিন্তা জগতে তিনি ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় চিন্তক।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধভাষা:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্যশিল্পের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। তাঁর প্রবন্ধভাষা ছিল মৌলিক ও স্বতন্ত্র। তিনি বাংলা গদ্যকে নতুন রূপ প্রদান করেছেন এবং সাহিত্যিক ভাবনাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। তাঁর প্রবন্ধভাষার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. সহজবোধ্যতা ও সরলতা:
বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যের ভাষাকে সহজবোধ্য এবং সরল করে তোলার জন্য সজাগ ছিলেন। তিনি ভাষার সৌন্দর্য বজায় রেখেও পাঠকদের কাছে বিষয়বস্তু সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন।
২. মননশীলতা:
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগুলির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর গভীর মননশীলতা। তাঁর লেখা চিন্তাশীল ও বিশ্লেষণাত্মক, যা পাঠকদেরকে ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে।
৩. উপলব্ধির তীক্ষ্ণতা:
বঙ্কিমচন্দ্র সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছেন। তিনি যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং পাঠকদেরকে নতুন উপলব্ধির পথে পরিচালিত করেছেন।
৪. প্রকাশের শৈলী:
তিনি সৃজনশীলভাবে বাংলা গদ্যে নতুন শৈলী সংযোজন করেছেন। তাঁর প্রবন্ধে ভাষার শৈল্পিকতা এবং রুচিশীলতা লক্ষণীয়।
৫. ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন:
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধভাষায় তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতামত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। তাঁর লেখায় ব্যক্তিত্ব এবং নিজস্বতা প্রবাহিত হয়।
৬. সাহিত্য ও দর্শন:
বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য সমালোচনা ও দার্শনিক চিন্তা উভয়ই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেছেন। তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধে তিনি সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।
৭. সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগুলি সমাজ ও ইতিহাসের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছে। তিনি সমাজের সমস্যাগুলি তুলে ধরে তার সমাধান প্রস্তাব করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ
১. সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ:
বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য সমালোচনায় সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র পরিত্যাগ করে পপুলার রীতি অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে “উত্তরপিরতি”, “গীতিকাব্য”, “বিদ্যাপতি ও জয়দেব”। এই প্রবন্ধগুলো সাহিত্যের আদর্শ রচনা হিসেবে গণ্য হয়।
তাঁর “শকুন্তলা”, “মিরান্ডা ও দেসদিমোনা” প্রবন্ধগুলিতে কালিদাসের শকুন্তলা এবং শেক্সপীয়ারের মিরান্ডা ও দেসদিমোনা এই তিনটি চরিত্রের আলোচনা করা হয়েছে। কালিদাস নাটকের শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং শেক্সপীয়ার ট্র্যাজেডি নাটকের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভার অধিকারী। বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নীতি প্রচার নয় বরং চিন্তন ও অনুভূতির উন্নতি হিসেবে দেখতেন। রবীন্দ্রনাথও সৌন্দর্য ও আনন্দকে সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন।
২. ইতিহাস ও সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধ:
উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহ: ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, ‘বাঙ্গালার কলঙ্ক’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাসের ভগ্নাংশ’, ‘ভারত কলঙ্ক’।
৩. দার্শনিক প্রবন্ধ:
বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক যুগের ব্যবহারিক জীবনচর্চায় প্রভাবিত ছিলেন। প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য সমাজ দার্শনিক মিল ও বেনথামের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তা মানুষের সামাজিক কল্যাণের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে যীশু বা শাক্যসিংহ যদি গৃহী হয়ে ধর্ম প্রবর্তক হতে পারতেন, তবে তাদের ধর্ম অসম্পূর্ণ থাকত। আদর্শ পুরুষ হিসেবে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বিবেচনা করতেন, যিনি গৃহী এবং সন্ন্যাসী উভয় ভূমিকায় সফল।
৪. সরস কৌতুকপূর্ণ রচনা:
‘কমলাকান্তের দপ্তর’ একটি উল্লেখযোগ্য কাজ, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র কমলাকান্ত চক্রবর্তী। এই গ্রন্থের তিনটি অংশ রয়েছে: ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ‘কমলাকান্তের পত্র’, ‘কমলাকান্তের জোবানবন্দী’। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের সাথে ভি কুইন্সীর ‘Confessions of an English Opium Eater’ এর কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। বঙ্কিম নিজেও গ্রন্থটিকে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে মনে করতেন।