Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান কয়টি ও কী কী? ছোটগল্পের গঠন কৌশল ও প্রকারভেদ আলোচনা করো

গল্প আর ছোটগল্প এক নয়। গল্প হল বর্ণিত আখ্যান। কিন্তু ছোটগল্পে আখ্যানকে বিশেষ রীতি, শৈলী ও রূপে প্রকাশ করা হয়। সাহিত্য-শিল্পের মধ্যে ছোটগল্প হল সর্বাধুনিক। ছোটগল্পের জন্ম হয়েছে উনিশ শতকে। শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারে এবং প্রযুক্তি ও যন্ত্রের প্রভাবে মানুষের জীবনে এসেছে ব্যস্ততা। আগের মতো বড় বড় সাহিত্য পড়ার সময়ও সংকুচিত হয়েছে। অথচ মানুষ জীবনের কথা জানতে চায়, সাহিত্য পড়তে চায়। আধুনিক মানুষের উপযোগী করে ছোটগল্প-শিল্পের আবির্ভাব হয়েছে।

ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। ছোটগল্প প্রথমে গল্প তারপর ছোট। পাঁচশত থেকে দুই হাজার শব্দের মধ্যে ছোটগল্প রচিত হওয়া উত্তম। তবে এক-দুই পৃষ্ঠার ছোটগল্পও আছে, আবার তিরিশ-চল্লিশ পৃষ্ঠার ছোটগল্পও আছে। উপন্যাসের সঙ্গে ছোটগল্পের পার্থক্য হচ্ছে উপন্যাসে থাকে জীবনের বিস্তৃত উপাখ্যান, আর জীবনের একটিমাত্র তাৎপর্যপূর্ণ অংশকে অবলম্বন করে রচিত হয় ছোটগল্প । উপন্যাস সবকিছু গ্রহণ করে, কিন্তু ছোটগল্প সব বাহুল্য বর্জন করে। 

ছোটগল্প কাকে বলে অর্থাৎ ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ

ছোটগল্পের সংজ্ঞা নানাভাবে বোঝানো হয়েছে। ছোটগল্প যে ছোট আকৃতির সাহিত্য রচনা তা নামেই বোঝা যায়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ছোটগল্প প্রথমে গল্প তারপর ছোট। এর আকৃতি কত বড় হতে পারে? এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, পাঁচশ থেকে দুই হাজার শব্দের মধ্যে ছোটগল্প রচিত হওয়া উত্তম। তবে এ নিয়ে একেবারে ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। এক দুই পৃষ্ঠার ছোটগল্পও আছে, আবার ত্রিশ—চল্লিশ পৃষ্ঠার ছোটগল্পও আছে। যেমন, বাংলা সাহিত্যে বনফুলের ছোটগল্পগুলো ছোট-ছোট, ওদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’, ‘অতিথি’ ইত্যাদি হল বড় আকৃতির ছোটগল্প।

উপন্যাসের সঙ্গে ছোটগল্পের পার্থক্য আছে। উপন্যাসে থাকে জীবনের বিস্তৃত উপাখ্যান। আর জীবনের দু’একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশকে অবলম্বন করে ছোটগল্প রচিত হয়। উপন্যাস সবকিছু গ্রহণ করে, কিন্তু ছোটগল্প সব বাহুল্য বর্জন করে। ছোট গল্পকে সেজন্য জীবনের খণ্ডাংশ বা slice of life বলা হয়। ছোটগল্প জীবনের একটা সমস্যার সংকটকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সেজন্য ছোটগল্প লেখকের অন্য দিকে দৃষ্টি দেবার অবকাশ নেই। জীবনকে নিয়ে প্রতীতিজাত অনুভূতিই ছোটগল্প রচনার মূল প্রেরণা। এ কারণে ছোটগল্প সবসময় লেখকের ব্যক্তিত্বমণ্ডিত হয়। গীতিকবিতা যেমন কবির ব্যক্তি অনুভূতির প্রকাশ, ছোটগল্পও অনেকাংশে ছোটগল্পকারের অনুভূতিময় রচনা। বিস্তৃত মানবজীবনকে দেখে বা উপলব্ধি করে লেখক যে-সব বিচিত্র অনুভূতি লাভ করেন সেগুলো ছোটগল্পের বিষয় হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের বিষয় ও রীতি সম্বন্ধে তাঁর ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় বলেছেন:

“ছোটো প্রাণ, ছোট ব্যথা            ছোটো ছোটো দুঃখ কথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতি রাশি              প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু-চারিটি অশ্রম্নজল।

নাহি বর্ণনার ছটা             ঘটনার ঘনঘটা

নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ।

অন্তরে অতৃপ্তি রবে,             সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।”

ছোটগল্প আঁটোসাঁটো রচনা, উপন্যাসের মতো নানা ঘটনা বা কাহিনির বিস্তৃতি ছোটগল্পে থাকে না। ছোটগল্পে চরিত্র সংখ্যা কম। ঘটনা উপস্থাপনায় নাটকীয় কৌশল বা চমক থাকে এবং ছোটগল্পের সমাপ্তিও হয় চমকপূর্ণ। সে জন্য ছোটগল্প পাঠে একটা অতৃপ্তি থাকে, মনে হয় আর কিছু যেন বাকি আছে। ছোটগল্পের কাহিনি দ্রুত পরিণামমুখী হয় এবং ছোটগল্পে থাকে একটিমাত্র বক্তব্য।

পরিশেষে বলা যায়, ছোটগল্প হল এমন এক সংক্ষিপ্ত গদ্য রচনা যা জীবনের মাত্র দু’একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখকের ধারণাগত বক্তব্যকে একমুখী রূপ দান করে।

ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য, ছোটগল্পের উপাদান, ছোটগল্পের গঠন কৌশল বা ছোটগল্পের লক্ষণ

১. গল্প আর ছোটগল্প এক নয়।

২. ছোটগল্প আধুনিক কালের সাহিত্যশিল্প।

৩. ছোটগল্প গদ্যে রচিত হয়।

৪. ছোটগল্পের আকার-আকৃতি ক্ষুদ্র। উপন্যাস থেকে ছোটগল্প পৃথক।

৫. ছোটগল্পের বিষয়বস্তু জীবনের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র নানা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কোনো বিশেষ অনুভূতি কিংবা উপলব্ধি।

৬. মানবজীবন সম্পর্কে কোনো বিশেষ প্রতীতি (Impression) ছোটগল্প রচনায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

৭. জীবনের কোনো বিশেষ সমস্যার সংকটই ছোটগল্পের উপজীব্য।

৮. ছোটগল্পে একটি মাত্র বক্তব্য থাকে।

৯. ছোটগল্প বাহুল্য বর্জন করে, আর দ্রুত পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়।

১০. ছোটগল্পের উপস্থাপনা আকস্মিক ও নাটকীয় হয় এবং পরিসমাপ্তিতেও এই আকস্মিকতা ও নাটকীয়তা থাকে।

১১. ছোটগল্পের চরিত্রসংখ্যা কম।

১২. ছোটগল্প আঁটোসাঁটো রচনা। ছোটগল্পের বর্ণনা ও ভাষার মধ্যে সংযম ও সংক্ষিপ্ততা  থাকবে।

১৩. ছোটগল্পের উপস্থাপনা ও পরিসমাপ্তি দুই—ই চমকপূর্ণ।

১৪. ছোটগল্প লেখকের ব্যক্তিত্বমণ্ডিত রচনা।

ছোটগল্পের উদ্ভব ও বিকাশ

গল্প বলা আর গল্প শোনার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। মানুষ যখন থেকে সভ্য হয়েছে, যখন থেকে চিন্তা ও কল্পনা করতে শিখেছে তখন থেকেই গল্প বলার রীতি শুরু হয়েছে। জনপদের বয়সী বা অভিজ্ঞ মানুষেরাই গল্প বলেন, আর অন্যেরা শোনে। লোকজীবনে দাদি—নানি বা মামি—খালারা গল্প বলে বলে শিশুদের ঘুম পাড়াতেন। বিচিত্র সেসব গল্প। কোনো গল্প রাজপুত্র— রাজকন্যার, কোনো গল্প রাক্ষস—খোক্কসের, দৈত্য—দানবের, কোনো গল্প পক্ষীরাজ ঘোড়ার, কোনো গল্প দুরন্ত অভিযানের। সেসব গল্প শুনে শিশুমন কল্পনার পাখায় ভেসে বেড়ায়। তারও ইচ্ছে ব্যঙ্গমা—ব্যঙ্গমির পিঠে চড়ে সে তেপান্তরের মাঠ পার হয়। গল্পের ভুবনে অবশ্য সবাই আছে- শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সকলেই। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে গল্পের রীতিনীতিরও পরিবর্তন হয়েছে, বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও নানা বৈচিত্র্য যুক্ত হয়েছে। গদ্যভাষার প্রতিষ্ঠা লাভের পরে গল্পের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ছোটগল্পের ইতিহাস সুদীর্ঘ কালের। পৃথিবীর মানবগোষ্ঠী এক সময় একজাতীয় গল্প বলত। কিন্তু সেই মানবগোষ্ঠী যখন পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন এক এক এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে গল্পের মধ্যে রূপান্তর সাধিত হয়।

আজকের দিনে তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গিয়েছে পৃথিবীর নানা জায়গার প্রাচীন গল্পগুলোর মধ্যে মিল আছে। এই মিল দেখা যায় রূপকথায়, উপকথায়, নীতিগল্পে ও লোককাহিনিতে। অর্থাৎ এগুলোই হচ্ছে প্রাচীন গল্প। এগুলোর সঙ্গে আরো ছিল পুরাণ কথা, আখ্যান, আখ্যায়িকা, ধর্মকথা ইত্যাদি। ভারতে প্রাচীন গল্পগুলোর রূপ দেখা যায় জাতক কাহিনি (বুদ্ধের পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত), পঞ্চতন্ত্র, কথা সরিৎসাগর, বৃহৎকথা, উদয়নকথা, দশকুমার চরিত, হিতোপদেশ ইত্যাদিতে, গ্রিসে গ্রিক উপাখ্যানে বিশেষ করে পুরাণ কাহিনিতে। আরবি ভাষায় রয়েছে আলেফ লায়লার কাহিনি; ফারসিতে পারস্য উপন্যাস ও তুতিনামা অর্থাৎ তোতাকাহিনি। ইউরোপে গল্পের উৎস পাওয়া গেল বাইবেলের নানা ধর্মীয় কাহিনিতে এবং মিথলজিতে। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে দুটি অসাধারণ গল্প সংকলন রচিত হল ইউরোপে। একটি ইংরেজ লেখক চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেলস্’, অন্যটি ইতালীয় লেখক বোক্কাচিয়োর ‘ডেকামেরন’। এই দুটি গল্পসম্ভার পরবর্তী ইউরোপীয় গল্প ও উপন্যাসের অর্থাৎ কথাসাহিত্যের পথদ্রষ্টা। অবশ্য ছোটগল্পের প্রকৃত শিল্পরূপের প্রকাশ ঘটে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের পরে। ততদিনে রোমান্স কাহিনি আর অভিযান কাহিনির যুগও অতিক্রান্ত হয়েছে; দেখা দিয়েছে বাস্তব জীবনের আলেখ্য, জীবনের নানা রঙ্গরূপ ও রসের কাহিনি। ফরাসি দেশেই ছোটগল্পের যথার্থ শিল্পরূপের বিকাশ ঘটে। জীবনের ছোট ঘটনাকে কীভাবে মহৎ তাৎপর্য দেওয়া যায় তা দেখালেন হিউনো, বালজাক, মেরিমে, দোদে প্রমুখ শিল্পী। ফরাসি দেশে গী দ্য মোপাসাঁর মতো জগৎ বিখ্যাত ছোটগল্পকারের আবির্ভাব ঘটল। অসংখ্য গল্পের রচয়িতা তিনি। ছোটগল্পকে যাঁরা চিরকালীন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন মোপাসা নিঃসন্দেহে তাঁদের একজন। রুশ সাহিত্য মূলত উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত হলেও ছোটগল্পেও এ সাহিত্যের অবদান প্রভূত। অনেক প্রতিভাবান ছোটগল্পকার রাশিয়াতেও জন্মেছেন, যেমন: পুশকিন, গোগোল, টলস্টয়, গোর্কি প্রমুখ। তবে সবচাইতে খ্যাতিমান হলেন আন্তন চেখভ, ছোটগল্পের আরেক মহারাজা। সরস ও বুদ্ধিদীপ্ত গল্পের জনক তিনি। রুশ সমাজের রূপকার এই অসাধারণ কথাশিল্পী ছোটগল্পকে অনুপম শিল্পকলায় পরিণত করেছেন। ইংরেজি সাহিত্যে ছোটগল্পে যাঁরা খ্যাতিমান তাঁদের মধ্যে সমারসেট মম, ডি.এইচ. লরেন্স, গ্রাহাম গ্রীন, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড উেল্লেখযোগ্য।
আমেরিকাতেও ছোটগল্পের পরিচর্যা হয়েছে। আমেরিকার গল্পকারদের মধ্যে বিখ্যাত ওয়াশিংটন আর্ভিং, ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হেনরি জেমস, এডগার এলান পো, মার্ক লন্ডন, ও হেনরি; জার্মানিতে বিখ্যাত সুডারম্যান আর টমাস ম্যান প্রমুখের নাম স্মরণীয়।
বাংলা সাহিত্যে গদ্য প্রতিষ্ঠার সূত্রে ছোটগল্প শিল্পেরও বিকাশ হয়েছে। তবে উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটগল্পের যথার্থ রূপ ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের পরে অনেক ভালো ও স্বনামখ্যাত শিল্পীদের কল্যাণে বাংলা ছোটগল্পও বিশ্বমান অর্জন করে।

বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে জড়িত। ছোটগল্পের ভাষার মাধ্যম গদ্য। উনিশ শতকের সূচনালগ্নে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার সূত্রে কিছু পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছিল, যেগুলো ছিল আখ্যানমূলক। পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘কথামালা’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’ জাতীয় ছাত্রপাঠ্য গল্পকাহিনি রচনা করেন। তবে এগুলো মৌলিক রচনা নয়। তা ছাড়া এগুলো ছোটগল্পও নয়। কলিকাতায় তখন যে নাগরিক জীবন গড়ে উঠছিল তার মধ্যে গল্পের উপাদান ছিল বহু। এমনিতে সুখ-দুঃখ পূর্ণ বাঙালি জীবন গল্পবস্তুতে ভরপুর। কিন্তু বাঙালি লেখকেরা ছোটগল্পের শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সূত্রপাত করেন। ইতিহাস বিচারে রবীন্দ্রনাথের আগেও দুই একজন গল্পকারের নাম উল্লেখ করা হয়। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের অনুজ পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ‘মধুমতী’ গল্পটিকে প্রথম বাংলা ছোটগল্প রূপে ধরা হয়। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বয়সে রবীন্দ্রনাথের বড়, কিন্তু তাঁর গল্পসংকলন ‘ওমর চরিত’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের ছোটগল্পগুলোর পরে প্রকাশ পেয়েছিল। রঙ্গব্যঙ্গ ও উদ্ভট কল্পনা ত্রৈলোক্যনাথের গল্পের বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের রীতিনীতি বুঝে নিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ে তাঁর গল্প প্রকাশ পেতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে যখন শিলাইদহ—শাহজাদপুরে ছিলেন, তখন অনেক গল্প লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের গল্পে বাংলার গ্রামজীবনের ছবি ও প্রকৃতিচিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। পরে নাগরিক জীবন নিয়ে তিনি সুন্দর সুন্দর গল্প লেখেন। তাঁর গল্পে নরনারীর সম্পর্কের এবং সমাজের নানা সমস্যার পরিচয় আছে। সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথ একশটির মতো গল্প লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোর সংকলনের নাম ‘গল্পগুচ্ছ’।
রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গল্পের বিষয়বস্তুতে ও রূপরীতিতে পরিবর্তন আসে। ভালো ভালো ছোটগল্প—শিল্পীর জন্ম হয় বাংলা সাহিত্যে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, বনফুল, বুদ্ধদেব বসু, সুবোধ ঘোষ, সৈয়দ মুজতবা আলী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর প্রমুখ। এঁরা সব উঁচুমানের গল্পলেখক। রবীন্দ্রনাথ ও এঁরা সবাই মিলে বাংলা গল্পকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিয়েছেন। মানব জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখের কথা, সমাজ সংকটের নানা প্রশ্ন, ঘরোয়া জীবন, সংসার চিত্র, আর্থিক জীবন সবই এঁদের গল্পে স্থান পেয়েছে। কেউ কেউ চমৎকার হাস্যরসের গল্প লিখেছেন। ভাষায় ও আঙ্গিকেও নানা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের গল্পের তুলনায় পরবর্তীকালের গল্পগুলোতে সমাজ বাস্তবতা বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনের শোষণ—বঞ্চনা ও নিপীড়নের সত্য চিত্রও এ গল্পগুলোতে আছে। তবে বাংলা গল্পে প্রধানত মধ্যবিত্ত জীবনের ছবিই বেশি পাওয়া যায়। গল্পলেখকেরাও প্রধানত মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এঁদের সমাজদৃষ্টি এবং বাস্তবতাবোধও প্রখর। এভাবে গত একশ বছর ধরে বাংলা গল্পের বিপুল সমৃদ্ধি ঘটেছে।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ছোটগল্প নানা ধারায় বিকশিত হতে থাকে। এ সময় বাংলা সাহিত্যে গল্পের অঙ্গনে বহু লেখকের আবির্ভাব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সনে প্রয়াত হন এবং তাঁর মৃত্যুর ছয় বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪৭ এ ভারত বিভক্ত হয়। পাকিস্তানি আমলে বাংলা সাহিত্যের ধারাও দুটো রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান বাংলাদেশ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে অভিহিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা তখন থেকে সাহিত্য—সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে এখানেও ছোটগল্প লেখকের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এঁদের কেউ কেউ যাঁরা আগে কলকাতায় লিখতেন, তাঁরা ঢাকা চলে আসেন। পাকিস্তান আমলে বাংলা ছোটগল্পের প্রথম পর্যায়ের লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, মাহবুব উল আলম, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রমুখ। আবুল মনসুর আহমদ ‘আয়না’ নামের ব্যঙ্গ গল্পগ্রন্থ লিখে খ্যাতিমান হন। 

এ পর্যায়ে মাহবুব উল আলম, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন জীবনধর্মী গল্প লিখেছেন। সেই সময় তরুণ বয়সী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গল্প লিখে সুনাম অর্জন করেন। তাঁর গল্পের উপস্থাপনরীতি ও ভাষা বেশ আকর্ষণীয় ও আধুনিক। এঁদের সমকালীন আরো কয়েকজন গল্পলেখক বাংলা গল্পের ধারাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এঁরা হলেন শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্দীন। এঁরা একাধিক গল্পগ্রন্থের প্রণেতা এবং বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
১৯৫২—এর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের সাহিত্য—সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন চেতনা ও জীবনচিন্তার প্রকাশ ঘটায়। গল্পের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। এই প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফল নতুন প্রজন্মের গল্প লেখকদের আবির্ভাব। এঁদের মধ্যে স্বনামধন্য হলেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, জহির রায়হান প্রমুখ। শামসুদ্দীন আবুল কালাম কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি গ্রাম বাংলার জীবনের রূপকার। আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলাদেশি ছোটগল্পের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একদিকে সমাজমনস্ক শ্রেণি সচেতন গল্প লেখক, অন্যদিকে মানুষের মনোলোকের রহস্য সন্ধানী। আবদুল গাফফার চৌধুরী একসময় অনেক গল্প লিখেছেন, এখন তিনি বিদেশে থাকেন এবং গল্প লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, তবে রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। জহির রায়হানের গল্পে পূর্ববাংলার সামাজিক বিক্ষোভ ধরা পড়েছে। সদ্য প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক মানবিক ধারার গল্প লেখক। বহু গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর ও সাইয়িদ আতিকুল্লাহ বেশি গল্প না লিখলেও এঁরা নাগরিক জীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন তাঁদের গল্পে।
ষাটের দশকে বাংলাদেশি গল্পের ধারায় পরিবর্তন আসে। সামাজিক জীবনের ও রাষ্ট্রের সমস্যা ও দ্বন্দ্বের নানা ঘটনা গল্পে ছাপ ফেলে। গল্পের বিষয়বস্তুত ও রীতিতেও নতুনত্ব আসে। এই সময়ের গল্পলেখকেরা চেয়েছেন বাংলা গল্পকে রূপরীতিতে আরো আধুনিক ও আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। এই অন্যতম সেরা গল্পকারদের মধ্যে রয়েছেন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এঁরা তিনজনই বিখ্যাত ছোটগল্পকার, তীক্ষèভাবে নাগরিক ও সমাজমনস্ক। এঁদের গল্পের বিষয়পরিচর্যা ও ভাষারীতিতেও ভিন্ন রূপ দেখা গিয়েছে। বহু গল্পগ্রন্থের প্রণেতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিঃসন্দেহে একজন উজ্জ্বল ছোটগল্পশিল্পী।

ষাটের দশকের অন্যান্য গল্পলেখকের মধ্যে রাহাত খান, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত ও আবু বকর সিদ্দিকের নামও উল্লেখ করতে হয়। রাহাত খান মধ্যবিত্ত জীবনের রূপ—রূপান্তরের গল্প লেখেন, আর আবু বকর সিদ্দিকের গল্পে আছে জীবনের সংগ্রামচিত্র। জ্যোতি প্রকাশের গল্পের ভাষাভঙ্গিতে নতুনত্ব রয়েছে। ষাটের দশকের আরো কয়েকজন খ্যাতিমান গল্পলেখক হলেন মুর্তজা বশির, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও রশীদ হায়দার। ৫২—র ভাষা আন্দোলন, ৬৬—র ছয় দফা দাবি, ৬৯—র গণ—অভ্যুত্থান, ৭০—র নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও ক্ষমতা প্রদানে পাকিস্তানিদের অনীহা প্রকাশ এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র আরো প্রশস্ত হয়। গল্পের ভুবনেও আসে নতুন উদ্দীপনা ও নতুন আগ্রহ। স্বাধীনতা— উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পের প্রধান উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সার্থক ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও সামাজিক জীবনের নানা সমস্যা ও দ্বন্দ্ব, আর্থিক টানাপোড়েন, মূ ল্যবোধের অবক্ষয়, নগরায়ণ, প্রযুক্তির বিকাশ এবং এগুলোর অভিঘাতে জীবনের রূপ—রূপান্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পে স্থান পেয়েছে। গল্পের ভাষা ও উপস্থাপন রীতিতেও এসেছে পরিবর্তন। সময়ের অগ্রযাত্রায় পরিবর্তন স্বাভাবিক। স্বাধীনতা—উত্তর বাংলাদেশে পুরোনো গল্পকারদের অনেকেই সক্রিয় ছিলেন এবং কেউ কেউ এখনো গল্প লেখেন। শক্তিমান নতুন গল্পকাররাও বাংলাদেশের ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করছেন। নতুন প্রজন্মের গল্পকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কায়েস আহমদ, মইনুল আহসান সাবের, হরিপদ দত্ত, মঞ্জু সরকার, নাসরিন জাহান, হরিশঙ্কর জলদাস প্রমুখ।

রেফারেন্স : 

কোর্স কোড : HSC-1854, উচ্চতর বাংলা-৩ (এইচএসসি প্রোগ্রাম), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। 

উৎস: https://www.ebookbou.edu.bd (সংগৃহীত) 

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

গবেষণার পর্ব বা গবেষণার পর্যায় কয়টি ও কী কী? আলোচনা করো

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান ও অনুসন্ধানই হলো গবেষণা। গবেষণার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা এবং মানুষের

Read More
গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষণা পদ্ধতি কাকে বলে? গবেষণা পদ্ধতি কত প্রকার ও কী কী? গবেষণার বৈশিষ্ট্য, গবেষণা পদ্ধতি ও কৌশল, গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক গবেষণার পদ্ধতি

গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.