Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের রিভিউ, বিশ্লেষণ, সম্পূর্ণ আলোচনা ও সমালোচনা এবং সারমর্ম বা সারাংশ, পটভূমি ও প্রেক্ষাপট!

বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত বাংলা ব্যঙ্গগল্পের জগতে আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ একটি কালজয়ী গ্রন্থ। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত এই গল্প গ্রন্থটির ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বন্ধু আবুল মনসুরের হাত-সাফাই দেখে বিস্মিত’ হয়েছিলেন; বলেছিলেন, ‘ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ।’
ব্যঙ্গরচনা ও আয়না আবুল মনসুর আহমদের অন্যতম সৃষ্টি তাঁর ব্যঙ্গরচনা । তাঁর প্রকাশিত ব্যঙ্গরচনা গ্রন্থের সংখ্যা চার : ‘ আয়না ‘ ( ১৯৩৫ ) , ‘ ফুড কনফারেন্স ‘ ( ১৯৪৪ ) , ‘ আসমানী পর্দা ‘ ( ১৯৫৭ ) ও ‘ গালিভরের সফর – নামা ‘ ( ১৯৫৯ ) । গ্রন্থগুলোতে গল্প ছাড়াও অন্যান্য রস – রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে । ‘ আয়না’র সাতটিই ব্যঙ্গ – গল্প : ‘ হুযুর কেবলা ‘ , ‘ গো – দেওতা কা দেশ ‘ , ‘ নায়েবে নবী ‘ , ‘ লীডরে কওম’, ‘মুজাহেদীন ‘, ‘ বিদ্রোহী – সংঘ ‘ ও ‘ ধর্মরাজ্য ‘।
আবুল মনসুর আহমদের গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও পরিহাসপ্রিয়তা । তবে নিছক পরিহাস সৃষ্টিই লেখকের উদ্দেশ্য নয়। প্রমথ চৌধুরীর মতো করুণ – রসের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে হাসির রসোচ্ছল বন্যা বয়ে আনতে তিনি চান নি । প্রমথ চৌধুরী ওরফে বীরবল মনে করতেন , ‘ করুণ রসে ভারতবর্ষ স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে , আমাদের সুখের জন্য না হোক , স্বাস্থ্যের জন্যও হাস্যরসের আলোক দেশময় ছড়িয়ে দেওয়া নিতান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে । প্রমথ চৌধুরীর সেই হাস্যরস একেবারে নির্মল না হলেও সমাজ-শোধনের প্রবল উদ্দেশ্যে সেটি ছিল না।
অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘সমাজকল্যাণ বা লোক শিক্ষার জন্য সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর সায় নেই।’
একেই অজিতকুমার ঘোষ বলেছেন , ‘প্রমথ চৌধুরীর হাসিতে কোন স্থায়ী প্রভাব ও গভীর উদ্দেশ্য পরিস্ফুট নহে।
পক্ষান্তরে আবুল মনসুর আহমদের গল্পের পেছনে তীক্ষ্ণ সমাজ – চেতনা বা সমাজ কল্যাণ উদ্দেশ্য কাজ করেছে । তাই দুঃখকে তিনি পরিহাস দিয়ে ব্যক্ত করেছেন । আমাদের সমাজের কিংবা জাতীয় জীবনের এক সময়কার যে সব অসঙ্গতি লেখককে পীড়া দিয়েছে, তা  ই তিনি তির্যক বাণীভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন । সাধারণত এ ধরনের কষাঘাত গাম্ভীর্যপূর্ণ হলে বড়ই অপ্রিয় ঠেকে , কিন্তু রসোচ্ছল হলে একসঙ্গে দুটো উদ্দেশ্য সফল হয়; অসঙ্গতি বা ভণ্ডামির বুকে কষাঘাত এবং সঙ্গে সঙ্গে হাসির খোরাক।
আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ রচনায় তাই দুটো দিক মুখ্য বিবেচ্য হতে পারে:
(১) রস – রচনা হিসেবে এর সার্থকতা বা রস – বিচার , এবং
(২) এই ব্যঙ্গের পেছনে লেখকের সমাজ দৃষ্টি, কিংবা তাঁর সমকালীন সমাজের অন্ধকার দিকের উন্মোচনে লেখকের সার্থকতা। এ দুটো দৃষ্টিকোণ ছাড়াও চরিত্র – সমাবেশ এবং ভাষা-প্রয়োগে লেখকের দক্ষতা এখানে গৌণত আমাদের বিবেচ্য।
আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ – গল্পের পটভূমি বিচারে এদেরকে প্রধানত তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায় : (১) ধর্মীয়,
(২) রাজনীতিক ও
(৩) আর্থ – সামাজিক
প্রথম ভাগের ব্যঙ্গগুলোতে তিনি ধর্মান্ধতা , ধর্মীয় কুসংস্কার , ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও ধর্ম – ব্যবসায়ের মুখোশ উন্মোচন করেছেন । দ্বিতীয় ভাগের রচনাগুলোতে তিনি সমকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিক নেতাদের অন্ধকার দিক ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
আর্থ-সামাজিক পর্যায়ের ব্যঙ্গগুলোতে তিনি প্রধানত বাঙালি সমাজ ও বাঙালি চরিত্রের অসঙ্গতি বা দোষ ত্রুটি সমূহ সংশোধন করবার প্রয়াস পেয়েছেন। আমাদের সমাজের শ্রেণী-চরিত্রের পরিচিতি সবগুলো পর্যায়ে কিছু না কিছু বিধৃত হয়েছে এবং directly or indirectly aim at social reform সবগুলো গল্পে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কেননা , ‘ ব্যঙ্গ – বিদ্রূপের আঘাতে সমাজ ও দেশের চৈতন্য জাগরণ তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এবং এই উদ্দেশ্যের কারণেই তিনি আমাদের কাছে একজন ব্যঙ্গকার ( Satirist ) রূপে অধিক খ্যাত হয়েছেন।
কিন্তু তিনি কি শুধুই ব্যঙ্গকার? তিনি যখন বলেন, ‘আমি অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যা লিখবো তা হবে আপোসহীন।” এবং এ আপোসহীন কষাঘাত ব্যঙ্গ – বিদ্রূপের মাধ্যমে Moliere- এর ভাষায় : to correct the vices of men while amusing them S- এর জন্য হয় , তখন তিনি অবশ্যই ব্যঙ্গকার । কিন্তু অন্যত্র যখন বলা হয় : ব্যঙ্গকার বড় কঠোর , বড় নির্মম , তিনি মানুষের দোষ ও ব্যাধি নগ্ন করে ।
পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত হয়ে উঠেন ; তাঁর হাসি একক , দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে তা প্রতিধ্বনিত হয় না । ” — তখন আবুল মনসুর আহমদকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যঙ্গকার বলা সত্যিই কঠিন । কেননা , অসঙ্গতির প্রতি তাঁর মনোভাব যতই কঠোর হোক না কেন , এর জন্যে দুঃখবোধ তাঁর ছিল । তিনি তাঁর সমাজকে ও সমাজের মানুষকে ভালোবাসতেন এবং এর মধ্যকার ব্যাধি তাঁকে পীড়িত করতো ; তাই এর প্রতিকারে তিনি সিভিল সার্জনের ভূমিকা নিতেও কসুর করেন নি । কিন্তু একে কখনো পৈশাচিক উন্মত্ততা বলা চলে না । এই দিক থেকে আবুল মনসুর আহমদের ভূমিকা অনেকটা হিউমারিস্ট – এর কাছাকাছি । কার্লাইল বলেছেন , ‘ Humour is sympathy with the seamy side of things , ১০ এই জাতীয় সহানুভূতি আবুল মনসুর আহমদের ক্ষেত্রে দুর্লভ নয়। হিউমারিষ্ট ভ্রান্ত, পতিত ও অনিয়মিত জীবনের পরিচয় দিয়ে আমাদের হাসান বটে , কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মুখের হাসি কান্নার স্রোতে ভাসতে থাকে। আবুল মনসুর আহমদের ক্ষেত্রেও এ কথা একেবারে ভুলে যাবার নয় । তিনি হাসান ঠিক , কিন্তু সে হাসির পিছনে যে অশ্রু আছে , সে কামড়ের পিছনে যে দরদ আছে , ‘১১ তাও সত্য । এ জন্য সমালোচককে বলতে শুনি : ‘ Abul Mansur Ahmad’s charecters showe humour , and he must have a sense of humour himself .
মূলত আবুল মনসুর আহমদের গল্পে ব্যঙ্গরস ( satire ) প্রধান হলেও এতে অনেক সময় করুণ হাস্য – রস ( humor ) পূর্বোক্তের অনুগামী হতে দেখা যায় । কখনো কখনো দুটো রসই মিশ্রভাবে এসেছে । হাসতে হাসতে কাঁদতে যাওয়ার মতো ব্যাপারও তাঁর রস রচনার ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয়। তাঁর ‘ আদুভাই ‘ একটি চমৎকার হিউমার চরিত্র। Wit- এর ব্যবহার ও তাঁর ব্যঙ্গ – গল্পে দেখা যায় ; বিশেষত সংলাপ রচনায় আবুল মনসুর আহমদ এই বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দিয়েছেন। Paradox গোছের উক্তির সুচতুর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত ও তার ব্যঙ্গ – রচনায় রয়েছে। তবে বৈদগ্ধ্য পূর্ণ হাস্যরস ( wit ) তাঁর গল্পের প্রধান রস নয় । তাঁর হাস্যরসে ব্যঙ্গ ও কারুণ্যই প্রধান। আরো স্থূলভাবে বললে , ব্যঙ্গ-রসই প্রধান। তাঁর ব্যঙ্গ রসাত্মক চরিত্রগুলো করুণ হাস্যরসাত্মক ( Humourous ) চরিত্রগুলো অপেক্ষা অধিকতর জীবন্ত ; যেমন ‘ হুযুর কেবলা ‘ গল্পের হুযুর কেবলা , নায়েবে নবী ‘ গল্পের মওলানা সুধারামী ইত্যাদি। উপযুক্ত আলোচনার সঙ্গে আর একটি কথা বলেই আমরা সরাসরি লেখকের গল্প – রাজ্যে প্রবেশ করছি । কথাটি এই যে , আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ – গল্পের মধ্য থেকে ‘ ব্যঙ্গ ‘ শব্দটি বাদ দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না; ‘ ব্যঙ্গ ‘ বর্তমান থাকে তো আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোও বর্তমান থাকে । অর্থাৎ তাঁর রচনায় হাস্য – রস ও সমাজ চেতনা দুটোই মিলে- ব্যঙ্গকে বাদ দিয়ে নয়, ব্যঙ্গের মধ্যেই । এবং প্রায়ই তাঁর ” ব্যঙ্গের বাহন হলো গল্প ‘আয়না’। আবুল মনসুর আহমদের ‘ আয়না’র প্রায় সব গল্পই ১৯২২ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে রচিত এবং ‘সওগাত ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ধর্মের নামে ভণ্ডামি আবহমান কাল থেকে ব্যঙ্গ – সাহিত্যের খোরাক। তেমনি ধার্মিকতার আবরণে সমকালীন সমাজের যে সব ব্যাধি আবুল মনসুর আহমদ দেখেছেন, তারই মুখোশ উন্মোচন করেছেন তিনি । ‘ আয়না’র অধিকাংশ গল্পেএখানে ব্যঙ্গ রচনায় আবুল মনসুর আহমদের অন্তর্দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর, ভাষা শাণিত এবং তাঁর বুদ্ধি অত্যন্ত দীপ্ত।
হুযুর কেবলা
‘আয়না’র ‘ হুযুর কেবলা ‘ গল্পটি এক ভণ্ড পীরের কাহিনী । এই ভণ্ড – পীরের পাল্লায় পড়েছে আধুনিক শিক্ষিত যুবক এমদাদ । এমদাদ অনেকটা কৌতূহল বশে , অনেকটা ভক্তিভরে পীরের মুরিদ হয়েছে । কিন্তু ভণ্ডপীরের চালাকি , তার লোলুপ দৃষ্টি এক সময় এমদাদের কাছে ধরা পড়ে গেলে পীরকে সে আক্রমণ করতেও কসুর করে নি । এর ফলে সুস্থ – বুদ্ধির এমদাদকে ‘ পাগল ‘ আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে । আর হুযুর কেবলা মুরিদের সুন্দরী বিবিকে তালাক পাড়িয়ে নিজে বিয়ে করে যে লালসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে- তার মুখোশ উন্মোচিত হলো না অন্ধ – ভক্তদের কাছে । ধর্মের নামে এই অন্ধত্বের জন্য সত্যিই দুঃখ জাগে।
বাংলাদেশে পীর – ব্যবসার একটি জীবন্ত চিত্র এই গল্প । নতুন মুরিদকে আকৃষ্ট করবার জন্য পীরের নানা কেরামতির বর্ণনায় লেখক চমৎকার দক্ষতার পরিচয় নিয়েছেন । বিশেষত উর্দু – আরবি মিশ্রিত বিশুদ্ধ সংলাপ – নির্মাণে লেখকের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় , হাস্যরস – স্রষ্টা পরশুরামের ‘ বিরিঞ্চি বাবা ‘ গল্পটির কথা । “ বিরিঞ্চি বাবার ভণ্ডামি অতি নিখুঁত, পরিপাটি ও নিপুণ কৌশলপূর্ণ।
বিশ্বাসী ভক্তগণের ভক্তি ও আনুগতা অনিবার্যভাবে আকর্ষণ করবার ক্ষমতা তাঁর আছে; কিন্তু তাঁর প্রতি পরশুরাম কোনো বিদ্বেষ ভাব দেখান নি, ধরা পড়বার পরও তাকে শাস্তি বিধান করেন নি । আবুল মনসুর আহমদের হুযুর কেবলার ভক্তদের আকর্ষণ করবার ক্ষমতা অনেকটা বিরিঞ্চি বাবার মতোই , তবে শাস্তি বিধানের মনোভাব আবুল মনসুর আহমদের ক্ষেত্রে পরশুরামের চেয়েও প্রবল । তিনি শুধু এমদাদের হাতেই হুযুর কেবলাকে লাঞ্ছিত করেন নি , বরং পাঠকের ঘৃণাকেও তীব্র করেছেন । আবুল মনসুর আহমদ পীরপ্রথাকে ঘৃণা করতেন । এই পীর – ব্যবসার স্বরূপ এবং ধর্মের নামে ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করেছেন ‘ হুযুর কেবলা’য় । গ্রাম – বাঙলার সহজ সরল চাষা – ভূষাদের ধর্ম – বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীরা সমাজকে কীভাবে প্রতারিত করছে- তারই একটি ব্যঙ্গ – মুখর বিশ্বস্ত রূপায়ণ এই গল্প ।
ভাষা – সংলাপের উপযুক্ত ব্যবহার (যদিও তা মাঝে মধ্যে পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য), কাহিনীর সরসতা গল্পটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে । একদিকে ব্যঙ্গের তির্যক কষাঘাতে হাস্যরসের অবতারণা , অন্যদিকে এর অন্তর্বর্তী অসঙ্গতি বা অন্ধত্বের জন্য করুণা— দু’ধরনের রসেই ‘ হুযুর কেবলা ‘ ভরপুর । এমদাদের মতো লেখকও দর্শনের ছাত্র ছিলেন, নাস্তিক আখ্যায়িত হয়েছিলেন এবং খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । এতে প্রতীয়মান হয় , লেখক নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে তাঁর গল্পে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছেন , এবং অভিজ্ঞতা থেকেই তিন সমাজকে সচেতন করবার প্রয়াস পেয়েছেন।

‘গো দেওতা-কা দেশ’

আবুল মনসুর আহমদ শুধু মুসলমানদের ধর্মান্ধতা নিয়ে ব্যঙ্গ করেন নি– ‘ গো দেওতা – কা দেশ ‘ গল্পে তিনি হিন্দুদের ধর্মান্ধতাকেও ব্যঙ্গ করেছেন । এখানে ‘ আনন্দ বাজার পত্রিকাকে খোঁচা দেওয়া হয়েছে , গো-হত্যা রোধের কুফল রসচ্ছলে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইংরেজের ভেদবুদ্ধি সৃষ্টির কৌশল , হিন্দু – মুসলমান দাঙ্গা প্রভৃতি ঐতিহাসিক তথ্যও হাস্য – রসে সিক্ত করে চমৎকার ভাবে উপভোগ্য করে তুলেছেন লেখক। এই গল্পে পরিবেশ – রচনা অনেকটা ভৌতিক। তবে কাহিনী নির্মাণে লেখকের বুদ্ধি দীপ্তি পাঠককে বিস্মিত করে । গল্পের শুরুতে এখানে কিছু নির্ভেজাল হাস্য – রসে অবতারণা করা হয়েছে। নির্ভেজাল এ – জন্যে যে , তা শুধু হাসবার জন্যই লেখা । বিবির সঙ্গে গল্পের নায়কের কথা বন্ধ হওয়ার পরের অবস্থা তারই চিত্র । কিন্তু এই ধরনের কৌতুকরস ( Fun- এর কাছাকাছি ) বেশিদূর অগ্রসর হয় নি । স্বপ্নে গো – দেওতার দেশের বিস্ময়কর পরিণতির দৃশ্যে পাঠক আবার ব্যঙ্গ – রসে সিক্ত হয়ে ওঠেন।

ধর্মরাজ্য

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য , বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের ( হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ) ধর্মান্ধতা সামাজিক ব্যাধির একটি বড় কারণ ছিল । অন্ধত্ব মুসলমানদের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি হিন্দুদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে । ১৯১৭ সালে লেখা ‘ ছোট ও বড়ো ‘ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের এ – অন্ধত্বের জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন , ‘ নিজে ধর্মের নামে পশু হত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশু – হত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব , ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না । এটি মূলত হিন্দুদের ‘ গো – হত্যা রোধ ‘ আন্দোলনের বীভৎসতার কথা । আবুল মনসুর আহমদ একেই বাঙ্গরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ।
‘ধর্মরাজ্য ‘ গল্পেও হিন্দু – মুসলমানদের সেই অতি ধার্মিকতার মনোভাব বিধৃত হয়েছে । এটিও ‘ গো – দেওতা – কা দেশে’র মতো স্বপ্নের ব্যাপার এবং উপজীব্য কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা । “ হিন্দু – মুসলিমের ধর্মযুদ্ধের একটা বাস্তব চিত্র এতে ব্যঙ্গ – রসের মাধ্যমে অতি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।
হিন্দুরা মসজিদের সামনে দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে মিছিল বের করবে এবং মুসলমানেরা এতে বাধা দেবে , ইসলামের ইজ্জতের জন্য জান নেসার করবে । বর্ণ – প্রথার ভেদাভেদ ভুলে সমস্ত হিন্দু কাতারবদ্ধ , মসজিদের সামনে বাদ্য বাজিয়ে নিজেদের হিন্দুত্ব ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে বলে । এতে সমকালীন নেতাদের ভূমিকাও অস্পষ্ট থাকে নি ; গান্ধি টুপি পরা মালকাছামারা কয়েকজন কংগ্রেস নেতা মিলিটারী ভঙ্গিতে হিন্দু জনতা তদারক করে বেড়াচ্ছেন । আর চান তারা মার্কা মোহাম্মদ আলী ক্যাপ পরা খেলাফতী নেতারা মুসলিম জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন । উভয় দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে অদূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন পুলিশের বড়কর্তা ইংরেজ । এভাবে এই গল্পে লেখক ব্যঙ্গ – বিদ্রূপের মাধ্যমে তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে অমানবিক ঘটনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন ।
উল্লেখ্য , বিশ শতকের এই পর্বে হিন্দু – মুসলমান দাঙ্গা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা । উভয় সম্প্রদায়ের এই অধঃপতন ভারতের বহু মনীষীকে ভাবিয়ে তুলেছিল । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ভেবেছেন । সচেতন লেখক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদকে কম পীড়িত করে নি এই সমস্যা । অন্যান্য আরো অনেক বিষয়ের মতো ভারতের এই প্রধান ব্যাধিকেও তাই তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন , এবং একজন ব্যঙ্গকার রূপে তাঁর ব্যঙ্গ – রচনায় এর স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন । তাঁর ব্যঙ্গের চাবুক কারো সঙ্গে আপোস করে নি । ইংরেজের ভেদ – নীতি , তৎকালীন রাজনীতিকদের সংকীর্ণতা এবং সর্বোপরি উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধতা কী করে এই ধরনের একটি অমানবিকThe satire is a positive art ( কিন্তু ‘ Positive ‘ হয়েও এটি কীভাবে রসের সঙ্গে হুল – ক্রিয়া সাধন করতে সক্ষম , তা আবুল মনসুর আহমদের আরো অনেক রচনার মতো ‘ ধর্মরাজ্যে’ও প্রকাশিত হয়েছে । ইংরেজদের বিচারের রায় পাওয়ার পর মূর্ত ভারতবাসীর স্বধর্মপ্রীতির যেই কৌতূকোদ্দীপক চিত্র দেখানো হয়েছে — তাতে হাসির খোরাক আছে যথেষ্ট , কিন্তু উভয়ের অন্ধত্বের জন্য কান্নারও অবকাশ আছে ।

মুজাহেদিন

নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য মোল্লা – মৌলবিরা কত জঘন্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তার একটি মর্মভেদী চিত্র হলো ‘ মুজাহেদিন ‘ গল্প । নিজের স্বার্থ রক্ষাকল্পে গ্রামের খারেজি মাদ্রাসার মৌলবি নবাগত মওলানার সহযোগিতায় গ্রামের মাঝে মযহাবী – কোন্দল সৃষ্টি করেছে । এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে গ্রামের নিরীহ জনসাধারণের মধ্যে কোন্দল – মারামারি , জেল – জরিমানা ইত্যাদি লাঞ্ছনা – গঞ্জনার ভোগান্তি । আর স্বার্থবাজ মোল্লা – মৌলবিরা গ্রামবাসীদের মধ্যে আত্মকলহ লাগিয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বহাসের পুস্তিকা এই বীভৎস চিত্র গ্রাম – বাঙলায় এক সময় প্রচুর দেখা গেছে । লেখক ‘ আত্মকথায় বলেছেন , ‘ তৎকালে হানাফী মোহাম্মদীর বিরোধ , বহাসের সভা , সভাশেষে মারামারি এবং পরিণামে মামলা মোকদ্দমা ও জেল জরিমানা ছিল সাধারণ ব্যাপার । এ প্রসঙ্গে তিনি ‘ মোজাহেদিন ‘ গল্পটি কাল্পনিক নয় বলেও উল্লেখ করেছেন । অতএব নির্দ্বিধায় বলা চলে , ‘ মোজাহেদিন ‘ গল্প তাঁর জীবন – অভিজ্ঞতার ব্যঙ্গাত্মক বিবৃতি । এটি শুধু ব্যঙ্গই নয় , বাঙালি মুসলমানদের এককালের সমাজ ইতিহাসও। গল্পটি হাস্য – রসের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে করুণ রসে শেষ হয়েছে । শেষের দিকে সাদতের ক্ষেত্রে ‘ এক বিন্দু অশ্রু অতি ধীরে ধীরে তাহার গও বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল’২১– উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের হৃদয় ও করুণ – রসে বিগলিত হয়ে ওঠে ।

নায়েবে নবী

‘নায়েবে নবী’ গল্পটি খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা । ধর্ম – ব্যবসায়ী মোল্লা মৌলবিদের আরেকটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র এটি । লেখকের কালের সমাজচিত্র বাস্তবসম্মতভাবে অঙ্কিত হয়েছে এতে ; তাঁর ‘ আত্মকথা ‘ পড়বার পর এর অনেক চিত্রই সাদৃশ্যমূলক মনে হবে- যেমন , স্কুল ছেলের তুর্কী – টুপি পোড়ানো , বাহাস ইত্যাদি । গল্পের প্রধান চরিত্র মৌলবি সুধারামীর আগমন ‘ শরা জারির উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এক শুভ মুহূর্তে । আর সে শুভ মুহূর্তের ভিত্তিভূমি লেখকের তির্যক ভাষায় বর্ণিত : ‘ কোথাও দীর্ঘদিন থাকিতে গেলে তথায় বিবাহ করা সুন্নত । তা না হইলে শহওয়াৎ গালের হয় । এবং নফসে আম্মারা দেহের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ঢালিয়া দেয় । তাই সুধারামী সাহেব কেবল সুন্নাতের ইয্যত রক্ষা ও শয়তানের বদমায়েশির রাস্তা বন্ধ করিবার জন্য ঐ সমস্যাকে জিয়ে রেখেছিল , তা আবুল মনসুর আহমদের রূপায়ণ দক্ষতায় প্রকাশিত হয়েছে।
The satire is a positive art ( কিন্তু ‘ Positive ‘ হয়েও এটি কীভাবে রসের সঙ্গে হুল – ক্রিয়া সাধন করতে সক্ষম , তা আবুল মনসুর আহমদের আরো অনেক রচনার মতো ‘ ধর্মরাজ্যে’ও প্রকাশিত হয়েছে । ইংরেজদের বিচারের রায় পাওয়ার পর মূর্ত ভারতবাসীর স্বধর্মপ্রীতির যেই কৌতূকোদ্দীপক চিত্র দেখানো হয়েছে — তাতে হাসির খোরাক আছে যথেষ্ট , কিন্তু উভয়ের অন্ধত্বের জন্য কান্নারও অবকাশ আছে । 8 নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য মোল্লা – মৌলবিরা কত জঘন্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তার একটি মর্মভেদী চিত্র হলো ‘ মুজাহেদিন ‘ গল্প । নিজের স্বার্থ রক্ষাকল্পে গ্রামের খারেজি মাদ্রাসার মৌলবি নবাগত মওলানার সহযোগিতায় গ্রামের মাঝে মযহাবী – কোন্দল সৃষ্টি করেছে । এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে গ্রামের নিরীহ জনসাধারণের মধ্যে কোন্দল – মারামারি , জেল – জরিমানা ইত্যাদি লাঞ্ছনা – গঞ্জনার ভোগান্তি । আর স্বার্থবাজ মোল্লা – মৌলবিরা গ্রামবাসীদের মধ্যে আত্মকলহ লাগিয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বহাসের পুস্তিকা এই বীভৎস চিত্র গ্রাম – বাঙলায় এক সময় প্রচুর দেখা গেছে ।
লেখক আত্মকথায় বলেছেন , ‘ তৎকালে হানাফী মোহাম্মদীর বিরোধ , বহাসের সভা , সভাশেষে মারামারি এবং পরিণামে মামলা মোকদ্দমা ও জেল জরিমানা ছিল সাধারণ ব্যাপার । এ প্রসঙ্গে তিনি ‘ মোজাহেদিন ‘ গল্পটি কাল্পনিক নয় বলেও উল্লেখ করেছেন । অতএব নির্দ্বিধায় বলা চলে , ‘ মোজাহেদিন ‘ গল্প তাঁর জীবন – অভিজ্ঞতার ব্যঙ্গাত্মক বিবৃতি । এটি শুধু ব্যঙ্গই নয় , বাঙালি মুসলমানদের এককালের সমাজ ইতিহাসও । গল্পটি হাস্য – রসের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে করুণ রসে শেষ হয়েছে । শেষের দিকে সাদতের ক্ষেত্রে ‘ এক বিন্দু অশ্রু অতি ধীরে ধীরে তাহার গও বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল’২১– উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের হৃদয় ও করুণ – রসে বিগলিত হয়ে ওঠে ।
‘ নায়েবে নবী ‘ গল্পটি খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা । ধর্ম – ব্যবসায়ী মোল্লা মৌলবিদের আরেকটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র এটি । লেখকের কালের সমাজচিত্র বাস্তবসম্মতভাবে অঙ্কিত হয়েছে এতে ; তাঁর ‘ আত্মকথা ‘ পড়বার পর এর অনেক চিত্রই সাদৃশ্যমূলক মনে হবে- যেমন , স্কুল ছেলের তুর্কী – টুপি পোড়ানো , বাহাস ইত্যাদি । গল্পের প্রধান চরিত্র মৌলবি সুধারামীর আগমন ‘ শরা জারির উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে এক শুভ মুহূর্তে । আর সে শুভ মুহূর্তের ভিত্তিভূমি লেখকের তির্যক ভাষায় বর্ণিত : ‘ কোথাও দীর্ঘদিন থাকিতে গেলে তথায় বিবাহ করা সুন্নত । তা না হইলে শহওয়াৎ গালের হয় । এবং নফসে আম্মারা দেহের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ঢালিয়া দেয় । তাই সুধারামী সাহেব কেবল সুন্নাতের ইয্যত রক্ষা ও শয়তানের বদমায়েশির রাস্তা বন্ধ করিবার জন্য ঐ গ্রামের পুত্রহীন এক গৃহস্থের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন । মৌলবি সুধারামী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবি মুনশী গরিবুল্লাহকে সুকৌশলে ঘায়েল করে ‘ গ্রামের সরদার বা শরিয়তী শাসক ‘ হবার সুযোগ লাভ করেন । গ্রামের অশিক্ষিত জনসাধারণের কাছে তিনি ধর্মের দোহায় পেড়ে নিজের আয়ের রাস্তা সুগম করেন । মজলিসের লোকদের কাছে কৌশলে নিজের আর্থিক অসঙ্গতির কথা ব্যক্ত করেন । প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলবি মুনশীর সাথে টিকে থাকার জন্য হাতাহাতি করতেও কসুর করেন না তিনি । পক্ষান্তরে মৌলবি মুনশী ও স্বার্থরক্ষার জন্য সমান তৎপর । স্বার্থরক্ষা না হলে তাঁরা লাশের সামনেও হাতাহাতি করতে প্রস্তুত । লেখক এই রস – রচনার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ভণ্ড ও ধূর্ত ধর্ম – ব্যবসায়ীদের একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন । এরা যে কীভাবে ধর্মকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন- তা লেখকের বর্ণনা না পড়লে এতটুকু উপলব্ধি করবার জো নেই । ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের শুধু বাইরের রূপই নয় বরং অন্তরের রূপও অনাবিষ্কৃত থাকে নি এই বর্ণনায় । অন্দরে যে মুরগি রান্না হচ্ছিল তার খুশবু নাকে প্রবেশ করাতে মৌলবি সুধারামীর কালামে পাক আবৃত্তির কণ্ঠ বুলন্দ হয় । খানা তৈরি হয়েছে জেনে ওয়াজ মাহফিলে ‘ মৌলবি সাহেব ভূমিকা হইতে সটান উপসংহারে চলিয়া যান । সুন্নতের দোহায় পেড়ে ‘ গ্রামের পুত্রহীন গৃহস্থের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন । ‘ নিজের আর্থিক দুরবস্থার কথা বলতে গেলে সত্যসত্যই তাঁর চোখে পানি দেখা দেয় । নিজের স্বার্থের প্রশ্ন আসলে ফতোয়া জারি করেন , ‘ এ – রকম ওয়াদা খেলাফে দোষ নাই । শুধু তা – ই নয় , যে সব নিয়ে তাঁদের কারবার সে – সবও স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে হলে তাঁদের কাছে বিষাক্ত ঠেকে । লেখকের ভাষায় : ‘ অহরহ আল্লাহর নাম যেকেরে অভ্যস্ত মৌলবী সাহেবের কানে ছেলেদের এ আল্লাহু আকবর ধ্বনি বিষাক্ত ছুরিকাঘাতের মত বিদ্ধ হইল ।
লেখকের বর্ণনায় হাসির খোরাক রয়েছে প্রচুর , কিন্তু কান্নার খোরাক যে নেই , তা নয় । আমাদের সমাজের এই অন্ধকার দিকটির যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী তাঁরাই বুঝতে পারবেন: এই হাসির পেছনে কতটা কান্না লুকানো আছে ‘ ।  বিশ শতকের তিনদশকে অবস্থান করেও এ – সব তথাকথিত আলেম জিদ ধরে বলতে পারেন : ইংরেজ রুমের সোলতানের প্রজা ‘ । কারণ তাঁরা তো থাকেন শুধু তাঁদের ধর্মের গণ্ডির মধ্যেই ; আর এতে তাঁদের শিক্ষা হয়েছে , ‘ তামাম জাহানের মধ্যে রুমের সোলতানাৎ সকলের চেয়ে বড় মুলুক । অতএব ইংরেজও রুমেরই অন্তর্গত ! নিজের স্বার্থ – সিদ্ধির জন্য এঁরা ধর্ম ব্যবসায়ে যতই সুচতুর হোন না কেন- দুনিয়াবী জ্ঞান যে এঁদের শূন্য- এটি তারই প্রমাণ । লেখক বিদ্রূপের মাধ্যমে সে – সত্যটি প্রকাশ করেছেন । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য , ডক্টর মু < ম্মদ শহীদুল্লাহ এই আলেম মূর্খদেরই বলেছিলেন : ‘ যারা দীন জানে , দুনিয়া জানে না ।

লীভবে কওম

‘ লীভবে কওম ‘ গল্পের নায়ক মওলানা ইসমাইল লেখাপড়ায় ব্যর্থ হয়ে ধর্ম ব্যবসায়ের মাধ্যমে আত্ম – প্রতিষ্ঠার পথ খোঁজেন । তবে তিনি শুধু ধর্মের সরাসরি প্রচারণায় নয় , বরং পরোক্ষভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে এগোন । তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে পত্রিকার আশ্রয় নেন প্রথমে মযহাবী বিদ্বেষকে পুঁজি করে , পরে বৃহত্তর সুবিধা লাভের আশায় অসম্প্রদায়িক ( মযহাব অর্থে ) এবং ক্রমান্বয়ে খেলাফতী – স্বরাজী ছদ্মাবরণে নিজের প্রতিষ্ঠাকে মজবুত করে তোলেন । ইসমাইলের প্রতিষ্ঠার স্তরগুলো যে ভাবে ধাপে ধাপে ক্রমগ্রসর — তা জনসেবা য়ুনিভার্সিটি’র ইয়াকুবের সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ । তবে উভয়ের অবলম্বন ভিন্ন ; প্রথম জনের অবলম্বন ধর্ম , দ্বিতীয় জনের অবলম্বন জনসেবা । বস্তুত লেখকের সমকালীন সমাজে মওলানা ইসমাইলের মতো চরিত্রের অভাব ছিল না । ( কারো কারো মতে , এর মূল চরিত্র মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ । ) মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের আত্মবিকাশের সেই সময়টিতে মওলানা ইসমাইলেরা ছিলেন সক্রিয় তাঁদের প্রতিষ্ঠাও এসেছিল যথেষ্ট সমাজের কাছে তাঁরা পরম ত্যাগনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি । কিন্তু এর ভেতরের ফাঁকটুকু প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আবুল মনসুর আহমদের কৌতূহলী দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে নি । ব্যঙ্গ – রচনার মাধ্যমে হলেও সেই সমাজ – ইতিহাস লেখক আমাদের কাছে তুলে ধরতে ভুলেন নি । এই গল্পের হানাফি – মোহাম্মদী বিরোধ , সীমান্তের ওহাবী কাফেলার প্রতি ইংরেজের কঠোর মনোভাব , আঞ্জুমানে তবলীগুল ইসলাম , হিন্দু – মুসলমান দাঙ্গা , স্বরাজ – খিলাফত আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনা গল্পটিকে ঐতিহাসিক দিক থেকে বাস্তবমুখী করে তুলেছে ।

বিদ্রোহী সংঘ

‘বিদ্রোহী সংঘ’ লেখকের কালের ভণ্ড বিদ্রোহীদের ব্যঙ্গচিত্র । ব্যক্তি স্বার্থে বিদ্রোহী হয়ে ইংরেজ তাড়াবার বাসনা , স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা , বিদ্রোহের নামে রাজনৈতিক পলায়নপর মনোবৃত্তির আশ্রয় ইত্যাদির মুখোশ উন্মোচন করেছেন আবুল মনসুর আহমদ এ গল্পে । সমালোচকের মতে সমাজে এক শ্রেণীর বিদ্রোহী আছে যাদের বিদ্রোহ পলায়নবাদের নামান্তর । রাজনৈতিক বিদ্রোহে ঝুঁকি আছে বলে তারা সামাজিক আচার অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বুলি পচিয়ে দাম ও নাম বাড়াবার চেষ্টা করে । অথচ সেটা যে অধিকাংশ সময় গা বাঁচাবার ফন্দী মাত্র মুখোশ একটু উন্মোচন করলেই সহজে বোঝা যায় । তাছাড়া , একশ্রেণীর বিদ্রোহী আছে , যাদের কাছে স্বাধীনতা , উচ্ছৃংখলতার নামান্তর । কিছু লোক ভাবত , ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এলে কোন প্রচলিত নিয়ম – কানুন মানতে হবে না- এমনকি ট্রাম – ট্রেনের ভাড়া পর্যন্ত দিতে হবে না । আবার কিছু কিছু ব্যক্তি আছে যারা দেশের প্রতি ভালবাসায় নয় , শুধু ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগবার কারণেই বিদ্রোহীদের দলে নাম লেখাতে চায় এবং রাতারাতি বিদ্রোহ বা বিপ্লব ঘটাতে চায় । এ জাতীয় বিদ্রোহীদের পরিচয় পাওয়া যায় বিদ্রোহী সঙ্গ গল্পে । আগাগোড়া উদ্ভট কৌতুক উপাদানে ভরা গল্প বিদ্রোহী সঙ্ঘ । চাকরি লাভে ব্যর্থ হয়ে একজন ব্যক্তি রাতারাতি প্রচও বিদ্রোহী হয়ে গেল এবং সত্যিকার বিদ্রোহীদের খোঁজে সারা কলকাতা ঘুরে অবশেষে ঢাকার বিদ্রোহী সঙ্ঘের সন্ধান পেল । বিদ্রোহীসঙ্ঘে ঘোরাফেরা করে সে হতাশ হল । কারণ বিদ্রোহীসঙ্গের বিদ্রোহ ছিল , প্রচলিত নিয়মকানুনের উল্টোটা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ । তাদের কাছে গান গাওয়া মানে বেসুরো চীৎকার , স্বাধীনতা মানে কোন আইন না মানা ইত্যাদি । তাদের বিদ্রোহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয় ; কেননা , ইংরেজরা হাত পা বাঁধলেও আত্মা বাঁধেনি।
বিশ্ব-মানবতা তাদের আদর্শ- সে অর্থে ইংরেজও তাদের পর নয়। এ ধরনের বিদ্রোহী সঙ্ঘের সন্ধানদাতার ওপর নব্য বিদ্রোহী খুব চটেছিল। হঠাৎ সন্ধানদাতার দেখা পেলে জানতে পারল সন্ধানদাতা আসলে সিআইডির লোক এবং সেও তার হতাশার কথা ব্যক্ত করল আসল বিদ্রোহীদের খুঁজে না পাওয়ার কারণে । অন্যদিকে নব্য বিদ্রোহীর আচরণে তথাকথিত বিদ্রোহীসঙ্ঘের সদস্যরা সন্দিপ্ত হল এবং ইংরেজদের কাছে লিখে জানাল ইংরেজ তাড়ানো তাদের উদ্দেশ্য নয়। ঘটনাচক্রে সে চিঠি পৌঁছবার আগে । ইংরেজ পুলিশদের সঙ্ঘের দিকে আসতে দেখা গেল। যথারীতি অভিনব কায়দায় নেতাসহ সকলে সঙ্ঘের অফিস থেকে পালাল।  এই চিত্রের মধ্যে ব্যঙ্গরসের অবতারণায় লেখকের দক্ষতা তুলনা রহিত।
তথ্য নির্দেশ
১. প্রমথ চৌধুরী , ‘ বীরবলের হালখাতা ‘ , ( পুনর্মুদ্রণ , কলিকাতা , ১৩৮০ ) , পৃ . ২৫
২. অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায় , “ বীরবল ও বাংলা সাহিত্য ‘ , ( পরিবর্ধিত দ্বি – স : কলিকাতা , ১৯৬৮ ) , পৃ . ১২৩-২৪
৩. অজিত কুমার ঘোষ , ‘ বঙ্গ সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা , ( কলিকাতা , ১৩৬৭ )
৪. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ” আবুল মনসুর আহমদের সাহিত্য – চর্চা প্রসঙ্গে ” , ” দৈনিক দেশ ‘ , ( ১৮ মার্চ , ১৯৮০ ) , পৃ ৪
৫. মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন , ” আবুল মনসুর আহমদ : এক বিপ্লবী নাম ” ” আবুল মনসুর আহমদ স্মরণে ‘, (স্যুভেনির ১ এপ্রিল ১৯৭৯), পৃ ১
৬. আবুল মনসুর আহমদের আয়না; ড . নুরুল আমিন সম্পাদিত

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.