অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১ জানুয়ারি, ১৯১৪ – ১৬ এপ্রিল, ১৯৫১) একজন প্রতিভাবান বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তাঁর একমাত্র উপন্যাস “তিতাস একটি নদীর নাম” বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে একটি অমর সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর জীবনকথা এবং সাহিত্যকর্মের বিশ্লেষণ করলে তার প্রতিভা ও সংগ্রামের এক অনন্য চিত্র উঠে আসে।
শৈশবকাল
অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গোকর্ণ গ্রামে। তিনি একটি দরিদ্র ধীবর পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা অধরচন্দ্রের মৃত্যু শৈশবেই ঘটে। পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে গ্রামের মালোদের চাঁদার টাকায় তাঁর লেখাপড়া চলত। তবুও, তিনি শৈশব থেকেই মেধার পরিচয় দেন।
শিক্ষা জীবন
১৯৩৩ সালে অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে কিছুদিন আই.এ. ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয়নি।
কর্মজীবনে অনুপ্রবেশ
১৯৩৪ সালে কলকাতা গমন করে ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ‘নবশক্তি’ বন্ধ হলে, তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজও করেন। এছাড়াও নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিতাস একটি নদীর নাম
অদ্বৈত মল্লবর্মণের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যকর্ম হলো “তিতাস একটি নদীর নাম”। এই উপন্যাসটি মূলত মৎস্যজীবী মালো সম্প্রদায়ের জীবন সংগ্রাম এবং তাদের সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
উপন্যাসের কাহিনী
উপন্যাসটির কাহিনী তিতাস নদী এবং তার আশেপাশের মানুষের জীবনযাত্রা ঘিরে আবর্তিত। কিশোর, সুবল, অনন্ত, বনমালী প্রমুখ চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজের সংগ্রাম ও দুঃখ-দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রকাশ ও পুনরুদ্ধার
“তিতাস একটি নদীর নাম” প্রথমে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিছু অধ্যায় প্রকাশিত হবার পর মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে তিনি পুনরায় লেখেন। কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে যাবার আগে পাণ্ডুলিপি বন্ধুবান্ধবদের কাছে রেখে যান।
চলচ্চিত্র রূপান্তর
১৯৭৩ সালে ঋত্বিক কুমার ঘটক “তিতাস একটি নদীর নাম” নামক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ঘটক চলচ্চিত্র নির্মাণের পিছনে তার অভীষ্ট হিসেবে বলেন যে, এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলার একটি খণ্ডজীবন ও প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরোগুলো দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
রচনাসমগ্র
অদ্বৈত মল্লবর্মণের অন্যান্য রচনা হলো:
- সাদা হাওয়া: আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
- সাগরতীর্থে: নাটকীয় কাহিনী।
- দল বেঁধে: গল্পগ্রন্থ।
- রাঙামাটি: একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম।
- জীবনতৃষ্ণা: অনুবাদিত সাহিত্যকর্ম।
- সমাজ সংস্কারক: সমাজ সংস্কারের উপর লেখা।
ব্যক্তিগত জীবন ও মহাপ্রয়াণ
অদ্বৈত মল্লবর্মণ খুবই দুঃখী জীবনযাপন করেছেন এবং নিজের আয়-উপার্জনের অধিকাংশই দুঃস্থদের সাহায্যে ব্যয় করেছেন। ৩৭ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নারকেলডাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনের অবসান হলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছে।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর একমাত্র উপন্যাস “তিতাস একটি নদীর নাম”-এর মাধ্যমে একটি চিরস্মরণীয় স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে যেমন গভীর মানবিকতা ও প্রান্তিক মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি আছে, তেমনি তাঁর জীবনযাপন ও সংগ্রামের কাহিনীও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।