হাসান হাফিজুর রহমান (১৪ জুন ১৯৩২ – ১ এপ্রিল ১৯৮৩) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, সাংবাদিক এবং সমালোচক। তার সাহিত্যিক কর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনা তার নামকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছে।
প্রাথমিক জীবন
হাসান হাফিজুর রহমান জামালপুর জেলার কুলকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুর রহমান এবং মা হাফিজা খাতুন। প্রাথমিক জীবন অতিবাহিত করেন জামালপুরে এবং পরবর্তীতে ঢাকায় চলে আসেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় নবকুমার স্কুলে, পরে সিংজানী হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করার পর, ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত পাস কোর্সে বি.এ. শেষ করেন।
কর্মজীবন
হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায়। এরপর সওগাত, ইত্তেহাদ ও দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন এবং ১৯৭৩ সালে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব পালন করেন।
সাহিত্যকর্ম
হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যকর্ম ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যময়। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, ও ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় সোনার বাংলায়, এবং ভাষা আন্দোলনের সময় তার কবিতাগুলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে।
কাব্য
- বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩): এই কাব্যগ্রন্থে তার সাহিত্যিক ভাবনা ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে।
- আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮): এই গ্রন্থে মানুষের কষ্ট ও বেদনাকে কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
- অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮): একটি গভীর ও চিন্তাশীল কবিতার সংগ্রহ।
- যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২): মুক্তিযুদ্ধের পরে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধের অনুভূতি ও চিন্তা উঠে এসেছে।
- শোকার্ত তরবারী (১৯৮১): এই গ্রন্থে শোক ও বেদনার অভিব্যক্তি পাওয়া যায়।
- প্রতিবিম্ব (১৯৭৬): একটি চিন্তাশীল কাব্যগ্রন্থ যা তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
- ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী (১৯৮৩): জীবন ও ভবিষ্যতের তত্ত্ব নিয়ে রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ।
প্রবন্ধ
- আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫): আধুনিক কবিতা ও কবিদের ভূমিকা নিয়ে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ।
- মূল্যবোধের জন্য (১৯৭০): সাহিত্য ও সমাজের মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা।
- সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯৭৩): সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা।
- আলোকিত গহ্বর (১৯৭৭): সাহিত্যিক ও চিন্তাশীল বিষয়ে প্রবন্ধ।
গল্প
- আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০): একটি সৃজনশীল গল্পগ্রন্থ যা তার গল্প লেখার দক্ষতা প্রদর্শন করে।
ভ্রমণকাহিনী
- সীমান্ত শিবিরে: একটি ভ্রমণকাহিনী যা সীমান্ত অঞ্চলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।
হাসান হাফিজুর রহমান বাংলা ভাষার সাহিত্যজগতকে তার কর্মের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন। তার কাব্য, প্রবন্ধ ও গল্পের মাধ্যমে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছেন এবং তার সাহিত্যিক অবদান আজও পাঠক ও গবেষকদের জন্য মূল্যবান।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
হাসান হাফিজুর রহমান বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং নাট্য চক্রের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ষাটের দশকে বাংলা ভাষার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবিতে আন্দোলন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং সাম্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন।
পুরস্কার ও পদক
হাসান হাফিজুর রহমানের সাহিত্যিক অবদান তাকে বহু পুরস্কারে ভূষিত করেছে। তার উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলির মধ্যে রয়েছে:
- পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭)
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭)
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১)
- সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬)
- অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
- সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২)
- মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪)
- বলদ পুরস্কার (১৯৯৯)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০২)
মৃত্যু
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল ক্লিনিকাল হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের একটি ক্ষতি এবং তার কাজ ও অবদান আজও পাঠক ও গবেষকদের জন্য প্রেরণার উৎস।