হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ – ১৫ নভেম্বর ২০২১) বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ছোট গল্পকার ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ দোয়া বখশ এবং মাতা জোহরা খাতুন। হাসান আজিজুল হক বর্ধমানের যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে স্কুল ফাইনাল এবং খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন, কিন্তু বিদেশের পরিবেশ ভালো না-লাগায় দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন
১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩১ বছর ধরে সেখানেই কর্মরত ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য মনোনীত হন এবং ২০১৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
সাহিত্য জীবন
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যজীবনের সূচনা হয় তার কৈশোরে। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘চারপাতা’ নামের একটি ভাঁজপত্রে, যেখানে তিনি রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য নিয়ে লিখেছিলেন। ১৯৬০ সালে ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪) প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ‘শকুন’ গল্পটি উল্লেখযোগ্য।
হাসান আজিজুল হক সাহিত্যচর্চার শুরুতেই কবিতা রচনায় আগ্রহী হলেও, পরবর্তীতে ছোট গল্প এবং উপন্যাস লেখার প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ‘শামুক’ নামে একটি উপন্যাস লিখে ‘মানিক স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতা’য় অংশগ্রহণ করেন, যদিও এই উপন্যাসটি পরে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ১৯৬৩ সালে সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় সন্দীপন গোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘সন্দীপন’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
প্রথম উপন্যাস এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্ম
হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’ ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের জন্য তিনি কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ‘শিউলি’ নামে একটি ছোট উপন্যাসও তার রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্ত।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪), ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭), ‘জীবন ঘষে আগুন’ (১৯৭৩), ‘পাতালে হাসপাতালে’ (১৯৮১), ‘নির্বাচিত গল্প’ (১৯৮৭), ‘আমরা অপেক্ষা করছি’ (১৯৮৮), ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প’ (১৯৯১), ‘রোদে যাবো’ (১৯৯৫), ‘মা মেয়ের সংসার’ (১৯৯৭), এবং ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৭)।
প্রবন্ধ এবং সম্পাদনা
হাসান আজিজুল হক প্রবন্ধ রচনায়ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ (১৯৮১), ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’ (১৯৮৬), ‘অপ্রকাশের ভার’ (১৯৮৮), ‘সক্রেটিস’ (১৯৮৬), এবং ‘একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা’ (২০০৫) উল্লেখযোগ্য।
তিনি সম্পাদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলী’ (১৯৭৯), ‘দুই বাংলার ভালোবাসার গল্প’ (১৯৮৯), ‘একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন’ (২০০০), এবং ‘বং বাংলা বাংলাদেশ’ (২০১২) উল্লেখযোগ্য।
স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক রচনা
হাসান আজিজুল হক তার জীবন ও সাহিত্য কর্মের নানা দিক নিয়ে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন। এর মধ্যে ‘ফিরে যাই, ফিরে আসি’ (২০০৯), ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১), ‘টান’ (২০১২), এবং ‘লন্ডনের ডায়েরি’ (২০১৩) উল্লেখযোগ্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা
হাসান আজিজুল হক তার সাহিত্য কর্মের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলো হল:
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭)
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০)
- একুশে পদক (১৯৯৯)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯)
- আনন্দ পুরস্কার (২০০৮)
- হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬)
- শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮)
পারিবারিক জীবন
হাসান আজিজুল হকের স্ত্রী শামসুন নাহার (১৯৫৮-২০১৩) ছিলেন। তাদের তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী।
মৃত্যু
হাসান আজিজুল হক দীর্ঘদিন নানা অসুস্থতায় ভুগে ১৫ নভেম্বর ২০২১ তার রাজশাহীর বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমাধিস্থ করা হয়।
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যিক জীবন এবং তার অসাধারণ সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন হিসেবে চিহ্নিত হবে। তার লেখা অসংখ্য পাঠকের মন ছুঁয়েছে এবং তার সৃষ্টি চিরকাল সাহিত্য প্রেমীদের কাছে মিস করবে।