নুরুল মোমেন (২৫ নভেম্বর ১৯০৮ – ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০) ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর বাংলাদেশী অধ্যাপক, নাট্যকার, শিক্ষাবিদ, রম্য সাহিত্যিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, অনুবাদক, কবি এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে “নাট্যগুরু” নামে অভিহিত করা হয়। আধুনিক বাংলা নাটকের পথিকৃৎ হিসেবে নুরুল মোমেনকে ধরা হয়, কারণ তাঁর নাট্যকর্মে বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারার সূচনা হয়েছে।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
নুরুল মোমেনের জন্ম ১৯০৮ সালের ২৫ নভেম্বর, তৎকালীন যশোর জেলার (বর্তমান ফরিদপুর) আলফাডাঙ্গায়। তাঁর পিতা নুরুল আরেফিন ছিলেন একজন জমিদার এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহিত্যিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যিক জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
কলকাতায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে নুরুল মোমেন ১৯১৬ সালে খুলনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে “সন্ধ্যা” নামে একটি পদ্য লিখে সেসময়কার জনপ্রিয় সাময়িকী “ধ্রুবতারা”-তে প্রকাশ করেন। এরপর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯২৪ সালে সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে ১৯২৬ সালে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে বিএ পাস করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের প্রথম বছরেই (১৯২৭) তিনি নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “মুক্তধারা” নাটকে বটু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নাট্য প্রতিযোগিতা এবং এখান থেকেই নুরুল মোমেনের নাট্যজীবনের শুরু। তিনি পরবর্তী তিন বছরে কার্জন হলে অনেক নাটক পরিচালনা এবং অভিনয় করেন।
কর্মজীবন ও সাহিত্যকর্ম
নুরুল মোমেন ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন এবং এরপর কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তবে তাঁর আসল পরিচয় ছিল একজন নাট্যকার এবং সাহিত্যিক হিসেবে। তিনি ১৯৩৯ সালে ঢাকায় “অল ইন্ডিয়া রেডিও” প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হন এবং শীঘ্রই নতুন এই মাধ্যমের অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৪১ সালে নুরুল মোমেন তাঁর প্রথম রচিত নাটক “রূপান্তর” রচনা এবং নির্দেশনা দেন। এই নাটকের প্লট এবং প্রধান চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সেই সময়কার প্রথাগত মুসলিম বাংলা নাটকের মধ্যে একটি নতুন ধারার সূচনা করে। “রূপান্তর” নাটকটি প্রগতিশীল ধারণা এবং নারীর প্রাধান্য নিয়ে লেখা, যা পরবর্তীতে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। এই নাটকটি এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার এটি নিয়ে প্রশংসা করেন এবং আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের পূজা সংখ্যায় নাটকটি প্রকাশ করে।
নুরুল মোমেনের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাটক হলো “নেমেসিস”, “যদি এমন হতো”, “নয়া খান্দান”, “আলোছায়া”, “শতকরা আশি”, “আইনের অন্তরালে”, “রূপলেখা”, “হোসেন সফদারের উইল”, “ভাই ভাই সবাই”, “এইটুকু এই জীবনটাতে”, “যেমন ইচ্ছা তেমন”, “আদিখ্যাতা”, “লন্ডন প্রবাসে”, “হ-য-ব-র-ল”, এবং “অন্ধকারটাই আলো”। এইসব নাটক নুরুল মোমেনের নাট্যধারাকে স্ফূর্তিময় করে তুলেছে এবং বাংলা নাট্যজগতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
রূপান্তর এবং প্রভাব
নুরুল মোমেনের “রূপান্তর” নাটকটি তাঁকে নাট্যকার হিসেবে প্রথম খ্যাতি এনে দেয়। এটি রচিত হয় ১৯৪১ সালে এবং রেডিওতে প্রথম প্রচারিত হয়। নাটকটির বিষয়বস্তু ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য একে সেই সময়কার বাংলা নাট্যসাহিত্যে একটি মাইলফলক করে তুলেছিল। এতে প্রগতিশীল ধ্যানধারণার প্রাধান্য ছিল, যা মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতা এবং নারীর অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে। মোহিতলাল মজুমদারসহ অন্যান্য সমালোচকেরা এই নাটকের প্রশংসা করেন এবং তা পরবর্তীতে আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যে একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিল, যা পরবর্তীতে নুরুল মোমেনকে “নাট্যগুরু” হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।
অন্যান্য সাহিত্যকর্ম
নুরুল মোমেনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে “নেমেসিস” নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি রচনা করা হয় ১৯৪৪ সালে এবং সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত “শনিবারের চিঠি” পত্রিকায় ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই নাটকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চরিত্রের দ্বন্দ্ব এবং তাদের অন্তর্নিহিত সংকট তুলে ধরা হয়েছে।
“যদি এমন হতো” নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে, যেখানে নুরুল মোমেন তাঁর অনন্য কল্পনাশক্তি এবং চরিত্রায়নের দক্ষতা প্রদর্শন করেন। “নয়া খান্দান” রচিত হয় ১৯৬১ সালে এবং প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে, যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সম্পর্কের জটিলতা এবং সংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
“আলোছায়া” নাটকটি রচিত হয় ১৯৬২ সালে এবং একই বছরের অক্টোবর মাসে এটি প্রকাশিত হয়। এতে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিক তুলে ধরা হয়েছে। “শতকরা আশি” নাটকটি নুরুল মোমেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম, যেখানে তিনি সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য একটি বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছেন।
মিডিয়া ও অনুবাদ কর্ম
নুরুল মোমেন শুধুমাত্র নাট্যকারই ছিলেন না, তিনি একজন দক্ষ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং অনুবাদকও ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং সেই সঙ্গে তিনি রেডিওতে নানা ধরনের সাহিত্যিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন বিদেশি নাটকের বাংলা অনুবাদ, যা বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার
নুরুল মোমেন ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৎ, নীতিবান, এবং সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশে অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন এবং সাহিত্যকর্ম বাংলা নাট্যসাহিত্যে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
১৯৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নুরুল মোমেন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সাহিত্যিক অবদান এবং নাট্যচর্চা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও পাঠকদের মননে ও চেতনায় জীবন্ত হয়ে আছে। “নাট্যগুরু” নুরুল মোমেন তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে বাংলার নাট্য ও সাহিত্য জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
নুরুল মোমেনের জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর নাট্যকর্ম, প্রবন্ধ, রম্য সাহিত্য এবং অনুবাদ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। “রূপান্তর”, “নেমেসিস”, “আলোছায়া” এবং অন্যান্য নাটকের মাধ্যমে তিনি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং দ্বন্দ্বকে নাট্যরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে সমাজের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়, যা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং জীবন আমাদের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং অনুপ্রেরণার উৎস।