দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই ১৮৬৩ – ১৭ মে ১৯১৩) ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে একজন অগ্রগণ্য বাঙালি কবি, নাট্যকার এবং সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন এবং তার নাম বাংলা সাহিত্যে ও সংগীতে অমর হয়ে আছে। তার সাহিত্য ও সংগীতকর্ম বাংলা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন, যা বাংলা সংগীত জগতে “দ্বিজেন্দ্রগীতি” নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে “ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” এবং “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” আজও সমান জনপ্রিয়। এছাড়াও তিনি অনেকগুলি নাটক রচনা করেন, যা বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রথম জীবন
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে, এক বিশিষ্ট ও শিক্ষিত পরিবারে। তার পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান, এবং তার মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের পরিবারে অনেক গুণীজনের সমাবেশ ছিল, যা তার শৈশব ও কিশোর বয়সে শিল্প ও সাহিত্যচর্চার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
শিক্ষা জীবন
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শিক্ষা জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন এবং পরে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে এফ.এ. এবং হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাশ করেন। এই সময়ের মধ্যে তার মধ্যে কবিতা রচনার প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মায় এবং তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাহিত্যকর্ম ও দেশপ্রেম
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেমের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। তার রচিত কাব্য ও নাটকগুলিতে ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি, এবং বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর্যগাথা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) এবং মন্দ্র। তার নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: একঘরে, কল্কি অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত এবং সিংহল বিজয়।
তার নাটকগুলিতে দেশপ্রেমের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাঠান-মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দেশের ভারতীয় মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বারবার তার নাটকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে।
হাস্যরস
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার সাহিত্যে হাস্যরসের যথাযথ ব্যবহার করেছেন। তার প্রহসনমূলক নাটকগুলি হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলিকে বিদ্রুপ করার ক্ষমতা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, তার নাটক “একঘরে” এবং “কল্কি অবতার” হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি তুলে ধরে।
তার রচিত কাব্যগ্রন্থ “হাসির গান” তার রসিকতার প্রতিভার অন্যতম উদাহরণ। এই গ্রন্থে তিনি বিয়োগান্তক ও নীতিশিক্ষামূলক বিষয়কে বিদ্রুপ করেছেন। যেমন:
“স্ত্রীর চেয়ে কুমীর ভাল, বলেন সর্বশাস্ত্রী।
ধরলে কুমীর ছাড়ে বরং, ধরলে ছাড়ে না স্ত্রী।”
এই ধরনের রসিকতার মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা গানের জগতে একটি অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তার গানের মূল সুর দেশপ্রেম ও সামাজিক সচেতনতা। তার রচিত প্রায় ৫০০ গান “দ্বিজেন্দ্রগীতি” নামে পরিচিত, যা বাংলার লোকজ ও শাস্ত্রীয় সংগীতের সংমিশ্রণে এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেছে।
তার বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে রয়েছে:
- “ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা”
- “বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ”
এই গানগুলি আজও বাংলার মানুষের মনে দেশপ্রেমের জাগরণ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে “ধনধান্য পুষ্প ভরা” গানটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং এখনও তা একইভাবে প্রাসঙ্গিক।
নাট্যকর্ম
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যকর্ম বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তার নাটকগুলি চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত: প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক, এবং সামাজিক নাটক।
প্রহসন
প্রহসনমূলক নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিদ্রুপকে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তার প্রহসনগুলি যেমন মজার, তেমনই সমাজের গভীর সমস্যাগুলিকে উদ্ঘাটন করে। এই শ্রেণির নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “একঘরে” এবং “কল্কি অবতার”।
ঐতিহাসিক নাটক
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তার ঐতিহাসিক নাটকগুলি ভারতের গৌরবময় অতীত এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইকে তুলে ধরেছে। তার ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- “রাণা প্রতাপসিংহ”
- “দুর্গাদাস”
- “নূরজাহান”
- “সাজাহান”
- “চন্দ্রগুপ্ত”
- “সিংহল বিজয়”
এই নাটকগুলিতে ভারতীয় ইতিহাসের বীরত্বগাঁথা ও নায়কোচিত চরিত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে জাগ্রত করা হয়েছে।
সামাজিক নাটক
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সামাজিক নাটকগুলি সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলি তুলে ধরে। তার সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “পরপারে” এবং “বঙ্গনারী”। এই নাটকগুলি সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, বিশেষত নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মৃত্যুবরণ
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯১৩ সালের ১৭ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরেও তার সাহিত্য ও সংগীতকর্ম বাংলা সংস্কৃতিতে অমর হয়ে রয়েছে। তার গান ও নাটকগুলি এখনও বাংলার মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এবং তার সৃষ্টিশীলতা বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।
উপসংহার
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। তিনি তার জীবনে সাহিত্য, সংগীত এবং নাট্যকর্মের মাধ্যমে এক অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেছেন। তার দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, এবং সামাজিক সচেতনতা তার সাহিত্যে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তার রচিত গান ও নাটকগুলি বাংলার সংস্কৃতিতে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে। তার সৃষ্টিকর্ম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় এবং তার সাহিত্যকর্ম বাংলার মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত থাকবে।