হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ – ১২ আগস্ট ২০০৪) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, এবং অধ্যাপক ছিলেন। তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রথাবিরোধিতা, মৌলবাদ বিরোধিতা, নারীবাদ, যৌনতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সোচ্চার মতামত প্রদান। তার সাহিত্যে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছে।
প্রাথমিক জীবন
হুমায়ুন আজাদ মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার কামারগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম নাম ছিল হুমায়ুন কবীর, যা ১৯৮৮ সালে পরিবর্তন করে হুমায়ুন আজাদ রাখা হয়। তার পিতা আবদুর রাশেদ ছিলেন শিক্ষক ও পোস্টমাস্টার, পরে ব্যবসায়ী হন। মা জোবেদা খাতুন গৃহিণী ছিলেন। আজাদ তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। তার শৈশব কেটেছে রাড়িখাল গ্রামে, যেখানে পদ্মা নদীর ধারে কেটেছে তার দিনগুলি।
শিক্ষা
১৯৫২ সালে তিনি দক্ষিণ রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ।
সাহিত্যকর্ম
কবিতা
হুমায়ুন আজাদ কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার শুরু করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০), ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ (১৯৯০), ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ (১৯৯৮) এবং ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪)।
গল্প
হুমায়ুন আজাদ প্রথম ছোটগল্প ‘অনবরত তুষারপাত’ লেখেন, যা ১৯৭৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। তার ছোটগল্পের বই ‘যাদুকরের মৃত্যু’ (১৯৯৬) এবং ‘বুকপকেটে জোনাকি পোকা’ (১৯৯৩) উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস
হুমায়ুন আজাদ ১৯৯৪ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ প্রকাশ করেন। এর পরের উপন্যাসসমূহের মধ্যে ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ’ (১৯৯৬), ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ (১৯৯৯), ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’ (২০০২), এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) উল্লেখযোগ্য।
ভাষাবিজ্ঞান গবেষণা
হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি’। এছাড়া, ‘বাক্যতত্ত্ব’ (১৯৮৪), ‘বাঙলা ভাষা’ (১৯৮৪), এবং ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৮৮) বইগুলো বাংলা ভাষাবিজ্ঞানকে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
প্রবন্ধ
তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ (১৯৭৬) এবং ‘নারী’ (১৯৯২) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘নারী’ গ্রন্থটি নারীবাদের বিষয়ে তার তীব্র মতামত প্রকাশ করে যা বিতর্কের সৃষ্টি করে। ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ (২০০৩) বইটিতে তিনি বাংলাদেশের সমাজের অবক্ষয়ের ওপর ব্যথিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
হুমায়ুন আজাদ ১৯৬৮ সালে লতিফা কোহিনুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক পুত্র অনন্য আজাদ। মৌলি আজাদ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করছেন।
বিশ্বাস ও দর্শন
আজাদ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং সরাসরি ধর্মের সমালোচনা না করলেও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন। তার লেখায় উদারপন্থা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং সমাজের সংস্কারের জন্য একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক-সামাজিক সমালোচনা
হুমায়ুন আজাদ ১৯৮০-এর দশক থেকে রাজনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। তার লেখায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সমালোচনা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যা তাকে সমকালীন বাংলাদেশি সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষ স্থান দিয়েছে।