সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ – ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর বিস্তৃত, যেখানে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ সহ সাহিত্যের সকল শাখায় তার স্বাক্ষর বিদ্যমান। ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা ও রূপে সৃজনশীলতা প্রদর্শন করেছেন।
প্রাথমিক জীবন
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এবং মাতা হালিমা খাতুন। শৈশব থেকেই লেখালেখির প্রতি তার আগ্রহ ছিল, কিন্তু তার বাবা তাকে ডাক্তারি পড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। সৈয়দ হক তার পিতার ইচ্ছা অগ্রাহ্য করে সাহিত্যের দিকে অগ্রসর হন এবং দ্রুত সাহিত্যজগতে পরিচিতি লাভ করেন।
শিক্ষা জীবন
সৈয়দ শামসুল হক তার প্রাথমিক শিক্ষা কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুল এবং কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে শুরু করেন। এরপর তিনি ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। পিতার ইচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তারি পড়ার পরিবর্তে, তিনি ১৯৫১ সালে বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) চলে যান এবং সেখানে এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। পরে, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও স্নাতক পাসের আগেই পড়াশোনা শেষ করেন এবং সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন।
কর্মজীবন
সৈয়দ শামসুল হক তার সাহিত্যজীবনের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, কাহিনী ও সংলাপ রচনা করেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র চিত্রনাট্য ছিল ‘মাটির পাহাড়’ (১৯৫৯), যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘পুরস্কার’ সহ আরও অনেক চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ এবং ‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বিবিসি বাংলার সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ করার পর, তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ ও সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন
সৈয়দ শামসুল হক প্রখ্যাত লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তার পারিবারিক জীবনও তার সাহিত্যজীবনের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
সাহিত্যকর্ম
কবিতা
সৈয়দ হক তার কবিতার মাধ্যমে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেন। ‘একদা এক রাজ্যে’ (১৯৬১) তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। পরবর্তীতে তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ (১৯৭০), ‘পরাণের গহীন ভিতর’ (১৯৮০), ‘বেজান শহরের জন্য কোরাস’ (১৯৮৯) ইত্যাদি। তার কবিতায় গভীর অনুপ্রেরণা, সমসাময়িক জীবন, মানব আবেগ ও চেতনা তুলে ধরা হয়েছে।
উপন্যাস
সৈয়দ হকের প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৬) প্রকাশিত হয়। এরপর তার লেখা ‘এক মহিলার ছবি’ (১৯৫৯), ‘অনুপম দিন’ (১৯৬২), ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ (১৯৬৪) ইত্যাদি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে। তার উপন্যাসগুলো সামাজিক বাস্তবতা, মানুষের মনস্তত্ত্ব ও মানব সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরেছে।
নাটক
সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬), ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮২), ‘এখানে এখন’ (১৯৮৮) সহ নানা নাটক রচনা করেছেন। তার নাটকগুলো মুক্তিযুদ্ধ, সমাজের বাস্তবতা এবং মানুষের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটায়।
মৃত্যু
২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সৈয়দ শামসুল হক ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যজগতে একটি বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করে। তার মরদেহ কুড়িগ্রামের সরকারি কলেজের পাশে দাফন করা হয়, যেখানে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সৈয়দ শামসুল হক তার সাহিত্যকর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬)
- একুশে পদক (১৯৮৪)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০০)
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৮২, ১৯৮৩)
- কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৮৩)
- নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০)
তার সাহিত্যকর্ম ও কাহিনির মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছেন এবং তার রচনাবলী আজও পাঠক সমাজে চিরকালীন প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।