জন্ম ও প্রাথমিক জীবন শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭ – ১৪ মে ১৯৯৮) বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক। জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল শেখ আজিজুর রহমান। তিনি পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার সবল সিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া ও মাতা গুলজান বেগমের সন্তান শওকত ওসমান কুমিল্লায় মক্তব ও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কুমিল্লায় কাটে, পরে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর বাংলায় মাস্টার্স করেন।
কর্মজীবন শওকত ওসমান ১৯৪১ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্সে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছা অবসরে যান। চাকরি জীবনের প্রথম দিকে ‘কৃষক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন। তিনি মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ তাঁকে ‘অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সাহিত্যকর্ম শওকত ওসমান বিভিন্ন ধারায় সাহিত্য রচনা করেছেন, যার মধ্যে নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, রাজনৈতিক লেখা এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য অন্তর্ভুক্ত। তাঁর রচনা প্রায় শতাধিক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
উপন্যাস
- জননী (১৯৫৮): শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস, যা তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুকে চিহ্নিত করে।
- ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২): শওকত ওসমানের প্রসিদ্ধ উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে বিবেচিত।
- সমাগম (১৯৬৭): সমাজ ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণমূলক উপন্যাস।
- চৌরসন্ধি (১৯৬৮): একটি মৌলিক উপন্যাস, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী তুলে ধরে।
- রাজা উপাখ্যান (১৯৭১): একটি ঐতিহাসিক কাহিনী।
- জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১): মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস।
- দুই সৈনিক (১৯৭৩): মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস।
- নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩): মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি উপন্যাস।
- পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩): একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির উপন্যাস।
- আর্তনাদ (১৯৮৫): মানবতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা উপন্যাস।
গল্পগ্রন্থ
- জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২): গল্পের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
- মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬): বিভিন্ন গল্পের সংকলন।
- ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৯০): একটি গল্পগ্রন্থ, যা ধর্ম ও সমাজের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
প্রবন্ধগ্রন্থ
- ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪): ভাষা ও ভাবনার সমন্বয়ে প্রবন্ধ।
- সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৫): সংস্কৃতি বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ।
- মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮৮): মুসলিম চিন্তাভাবনার পরিবর্তনের আলোচনা।
নাটক
- আমলার মামলা (১৯৪৯): একটি নাটক, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলি তুলে ধরে।
- পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০): রাজনৈতিক নাটক।
- তস্কর ও লস্কর: সামাজিক ও রাজনৈতিক নাটক।
- কাঁকর মনি: একটি ঐতিহাসিক নাটক।
- বাগদাদের কবি (১৯৫৩): একটি ঐতিহাসিক নাটক।
শিশুতোষ গ্রন্থ
- ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪): শিশুদের জন্য একটি সাহিত্যকর্ম।
- মস্কুইটো ফোন (১৯৫৭): শিশুদের জন্য একটি রম্যগল্প।
- ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩): শিশুদের জন্য একটি সামাজিক কাহিনী।
- পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭): শিশুদের জন্য একটি গল্পগ্রন্থ।
রম্যরচনা
- নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৮২): হাস্যরস ও রম্যরচনা।
স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ
- স্বজন সংগ্রাম (১৯৮৬)
- কালরাত্রি খ-চিত্র (১৯৮৬)
- অনেক কথন (১৯৯১)
- গুড বাই জাস্টিস মাসুদ (১৯৯৩)
- মুজিবনগর (১৯৯৩)
- অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৪)
- সোদরের খোঁজে স্বদেশের সন্ধানে (১৯৯৫)
অনূদিত গ্রন্থ
- নিশো (১৯৪৮-৪৯)
- লুকনিতশি (১৯৪৮)
- টাইম মেশিন (১৯৫৯): এইচ.জি. ওয়েলসের গ্রন্থের অনুবাদ।
- পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯)
- স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫)
- পাঁচটি নাটক (মলিয়ার, ১৯৭২)
- ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩)
- পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫)
- সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫)
পুরস্কার শওকত ওসমান তাঁর সাহিত্যের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন:
- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২)
- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬)
- প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৭)
- একুশে পদক (১৯৮৩)
- মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)
- স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭)
- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭)
শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট নাম, যার সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর রচনায় সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মুক্তচিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়।