বিহারীলাল চক্রবর্তী ২১ মে, ১৮৩৫ তারিখে কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। মাত্র চার বছর বয়সে মাতা মারা যান, যা তার শৈশবকালকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
শিক্ষাজীবন
বিহারীলাল চক্রবর্তী শৈশবে সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে শিক্ষা লাভ করেন। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিনি তিন বছর অধ্যয়ন করেন, যেখানে তার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আরও গভীর হয়।
বিবাহ
উনিশ বছর বয়সে, বিহারীলাল চক্রবর্তী দশ বছরের অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বিবাহ তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
কর্মজীবন
বিহারীলাল চক্রবর্তী প্রথমে “স্বপ্নদর্শন” (১৮৫৮) গ্রন্থের মাধ্যমে তার সাহিত্যজীবনের সূচনা করেন। এরপর তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে রয়েছে “সঙ্গীত শতক” (১৮৬২), “বঙ্গসুন্দরী” (১৮৭০), “নিসর্গসন্দর্শন” (১৮৭০), “বন্ধুবিয়োগ” (১৮৭০), “প্রেম প্রবাহিনী” (১৮৭০), “সারদামঙ্গল” (১৮৭৯), “দেবরানী” (১৮৮২), “বাউলবিংশতি” (১৮৮৭), “সাধের আসন” (১৮৮৯), “ধূমকেতু” (১৮৯৯) প্রভৃতি।
তিনি সম্পাদনা করেছেন “পূর্ণিমা” (১২৬৫ বঙ্গাব্দ), “সাহিত্য সংক্রান্তি” (১৮৬৬), “অবোধবন্ধু” (১৮৬৩) প্রভৃতি পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।
সাহিত্যকর্ম
বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা মূলত গীতিকাব্যধর্মী। তার কাজগুলি বাংলা কবিতার আধুনিক ধারাকে এক নতুন মোড়ে নিয়ে আসে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলালকে ‘ভোরের পাখি’ বলে উল্লেখ করেছেন, যা তার গীতিকবিতার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে।
- স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮): বিহারীলালের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এটি একটি গদ্য গ্রন্থ যা দেশের দুর্ভাগ্যের প্রতি গভীর আক্ষেপ প্রকাশ করে।
- সঙ্গীত শতক (১৮৬২): একশত বাংলা গানের সমষ্টি, যেখানে কবি তার জীবনের বিভিন্ন ভাবোদগমকে তুলে ধরেন।
- বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০): বিহারীলালের প্রথম স্বার্থক গীতিকাব্য। এই কাব্যে বঙ্গ নারীর বন্দনা করা হয়েছে এবং কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত।
- নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০): এই কাব্যটি ধারাবাহিকভাবে ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাতটি সর্গে রচিত।
- বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০): এই কাব্যে কবি তার চারজন বন্ধু এবং প্রথম স্ত্রীর বিয়োগব্যথা ব্যক্ত করেছেন।
- প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০): প্রেমের গূঢ় অনুভূতি ও ভাবনা প্রকাশের একটি কাব্য।
- সারদামঙ্গল (১৮৭৯): বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্য। এটি একটি আখ্যানকাব্য হলেও মূলত গীতিকবিতাধর্মী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্যকে সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
- সাধের আসন (১৮৮৯): গীতিকাব্য যা ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভাবনার গভীরতা প্রদর্শন করে।
- মায়াদেবী (১৮৮২), ধূমকেতু (১৮৮২), নিসর্গসঙ্গীত (১৮৮২), বাউল বিংশতি (১৮৮৭), গোধূলি (১৮৯৯): অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ যা বিহারীলালের সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্য ও গভীরতা প্রদর্শন করে।
মৃত্যু
বিহারীলাল চক্রবর্তী ২৪ মে, ১৮৯৪ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যজগতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করে, যা তার অমর রচনা ও সাহিত্যিক অবদান দ্বারা পূরণ হয়।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর সাহিত্যকর্ম বাংলা গীতিকাব্যের অগ্রগামী ধারা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং তার রচনা বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।