প্যারীচাঁদ মিত্র (২২ জুলাই, ১৮১৪ – ২৩ নভেম্বর, ১৮৮৩) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত। তিনি কলকাতায় ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই এক বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রামনারায়ণ মিত্র ছিলেন একজন কাগজ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী। প্যারীচাঁদ মিত্রের আদিনিবাস বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার পাণিসেহালা গ্রাম। তার ভ্রাতা কিশোরীচাঁদ মিত্রও ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব।
শৈশবেই প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা ভাষা শিখেন এবং পরে ফারসি ভাষা শেখার জন্য একজন মুন্সির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ইংরেজি ভাষার প্রতি তার আগ্রহের কারণে তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নকালে ডিরোজিও নামক প্রখ্যাত অধ্যাপক তার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন এবং তার প্রভাবের অধীনে প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষা জীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
কর্মজীবন
প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলার নবজাগরণের অন্যতম নেতা ছিলেন। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন এবং এখানেই তার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চিন্তার বিকাশ ঘটে। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বহুমুখী গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন যা তার সামাজিক সচেতনতা ও উদারনৈতিক মনোভাবের পরিচায়ক। এই পত্রিকা মহিলাদের শিক্ষা ও অধিকার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়াও, তিনি জনকল্যাণমূলক কাজের প্রতি উৎসাহী ছিলেন এবং বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন বেথুন সোসাইটি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য এবং পশু-ক্লেশ নিবারণী সভার সদস্য। তিনি ১৮৩৮ সালে জ্ঞানান্বেষণ সভার সদস্য হন, যা তার শিক্ষার প্রতি নিবেদনের প্রমাণ। তার ইংরেজি ভাষায় রচিত লেখাসমূহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যেমন ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, ক্যালকাটা রিভিউ, হিন্দু প্যাট্রিয়ট এবং ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া।
তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। স্ত্রী শিক্ষা প্রচার এবং বিধবাবিবাহ সমর্থনেও তিনি ছিলেন অগ্রণী। এছাড়াও, তিনি বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের বিরোধিতা করেন।
সাহিত্যকর্ম
প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- উপন্যাস
- আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮): এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই উপন্যাসে আলালী ভাষার ব্যবহার হয়েছে, যা বাংলা ভাষার নতুন রূপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এর অন্যতম প্রধান চরিত্র ঠকচাচা।
- মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায় (১৮৫৯): এই গ্রন্থে উদ্ভট কল্পনার প্রকাশ দেখা যায় এবং এটি তার সাহিত্যিক সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়।
- অভেদী (১৮৭১): এই উপন্যাসটি তার চিন্তাশীলতার আরেকটি উদাহরণ।
- বামাতোষিণী (১৮৭১): একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপন্যাস।
- যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫): একটি সাহিত্যিক কাজ যা সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
- রামারঞ্জিকা (১৮৬০): একটি সাহিত্যিক রচনা যা তার বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচায়ক।
- গীতাঙ্কুর (১৮৬১): একটি কাব্যগ্রন্থ যা তার কবিত্বের প্রতিচ্ছবি।
- কৃষি পাঠ (১৮৬১): একটি প্রবন্ধ যা কৃষির উপর তার চিন্তা প্রকাশ করে।
- ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত (১৭৭৮): একটি জীবনী গ্রন্থ যা ডেভিড হেয়ারের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
- এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা (১৮৭৯): একটি সমাজ গবেষণামূলক গ্রন্থ যা নারী শিক্ষা ও উন্নয়নের উপর আলোকপাত করে।
- অন্যান্য
- The Zemindar and Ryots: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার বিরুদ্ধে লেখা একটি গ্রন্থ যা তার সময়ে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
প্যারীচাঁদ মিত্রের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তিনি বাংলা ঔপন্যাসিকতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণীয়। তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা, সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতি তার গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেছে।