জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩ জুলাই, ১৮৯৮ − ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম প্রভাবতী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর তারাশঙ্কর পরিবারের প্রধান দায়িত্বে চলে আসেন। তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯১৬ সালে এবং পরবর্তীকালে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন। তবে ভগ্ন স্বাস্থ্য ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
পারিবারিক জীবন ১৯১৬ সালে উমাশশী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারাশঙ্কর। তাদের দুই পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যম কন্যা বুলু ১৯৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তারাশঙ্কর কখনো বিধানসভার সদস্য হননি, তবে ১৯৫২ সালে বিধান পরিষদের মনোনীত সদস্য এবং ১৯৬০ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন।
সাহিত্যকর্মের সূচনা ও উন্নতি ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস “চৈতালী ঘূর্ণি”। পরবর্তীতে ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), মন্বন্তর (১৯৪৩) ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তারাশঙ্করের সাহিত্যকর্ম মূলত আঞ্চলিক উপন্যাসের জন্য পরিচিত। তার উপন্যাসগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে।
স্বাধীনতা-উত্তর যুগে সাহিত্যকর্ম ১৯৫১ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫৫ সালে তারাশঙ্কর আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে গণদেবতা উপন্যাসের জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া পদ্মশ্রী (১৯৬২), পদ্মভূষণ (১৯৬৮) সম্মান লাভ করেন।
মৃত্যু ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্করের মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যু কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে হয়।
সাহিত্যকর্ম:
উপন্যাস তারাশঙ্করের উপন্যাস সংখ্যা প্রায় ৬০। তাঁর প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলিতে প্রধানত গ্রামের জীবন ও রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রতিফলন রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে, তিনি সমাজ ও মানুষের সনাতন জীবন-মুক্তির সাধনা নিয়ে কাজ করেন। তৃতীয় পর্বে, আঞ্চলিক উপন্যাসের পাশাপাশি আধুনিক শহুরে জীবন ও সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরেন। চতুর্থ পর্বের উপন্যাসগুলোতে নিয়তির খেলা ও অধ্যাত্মবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। পঞ্চম পর্বের উপন্যাসে ঘটনার বিন্যাসে পরিবর্তন আনেন এবং বাস্তব জীবনের প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন।
ছোটোগল্প তারাশঙ্করের ছোটোগল্পের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবন চিত্রিত হয়েছে। তাঁর গল্পগুলিতে আধ্যাত্মবাদ ও মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার আদর্শের প্রভাব দেখা যায়। “শেষকথা”, “শবরী”, “নব মহাপ্রস্থান” ইত্যাদি গল্পসমূহে এই বিষয়গুলি প্রতিফলিত হয়েছে।
মূল্যায়ন তারাশঙ্করের উপন্যাসগুলি বাস্তব জীবন ও সমাজের চিত্রের আধারে গড়ে উঠেছে। গবেষকরা তাকে রাঢ়ের অকৃত্রিম শিল্পী হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তার সাহিত্যে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক অবস্থা ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।