Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

আহমদ শরীফ এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

আহমদ শরীফ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ – ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী ভাষাবিদ, মনীষী এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধি। তিনি শুধু একজন শিক্ষাবিদ ও লেখক নন, বরং বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা, দর্শন, এবং লেখনীতে সমাজ পরিবর্তনের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

জন্ম ও পরিবার

আহমদ শরীফের জন্ম ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। তাঁর পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের একজন করণিক এবং মাতা মিরাজ খাতুন ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী। তাঁদের পরিবার মুসলিম হলেও প্রথাগত সামাজিক রীতিনীতির বাইরে শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছিল। আহমদ শরীফের পরিবারে শিক্ষার প্রচলন ছিল দীর্ঘদিন ধরে; বিশেষ করে তাঁর ষষ্ঠ পূর্বপুরুষ কাদের রজা কাজী দৌলতের ‘সতী ময়না লোরচন্দ্রানী’ পুঁথি নিজ হাতে নকল করেছিলেন, যা প্রমাণ করে তাঁদের পরিবারে শিক্ষার প্রতি অগাধ আগ্রহ। তাঁর পিতামহ আইন উদ্দিন ছিলেন সরকারি জজ কোর্টের নকল নবিস। আহমদ শরীফের কাকা ছিলেন বিখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, যাঁর সাহচর্যে তিনি শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন।

শিক্ষা

আহমদ শরীফের শিক্ষা জীবনের শুরু হয় পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ তিনি ১৯৬৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তাঁর গবেষণাধর্মী অভিসন্দর্ভের মাধ্যমে, যা ছিল “সৈয়দ সুলতান, তাঁর গ্রন্থাবলি ও তাঁর যুগ” শীর্ষক।

কর্মজীবন

আহমদ শরীফের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে, দুর্নীতি দমন বিভাগের গ্রিভেন্সিভ অফিসার হিসেবে। তবে নীতিগত কারণে তিনি এই চাকরি দীর্ঘদিন করতে পারেননি। তাঁর আসল স্বপ্ন ছিল শিক্ষাব্রতী হওয়া। তিনি ১৯৪৫ সালে লাকসামের পশ্চিম গাঁও নওয়ার ফয়জুন্নেসা কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা করেন। এরপরে, ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি তাঁর কাকা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগ্রহ করা পুঁথির মহাফেজখানার তত্ত্বাবধানে কাজ করার সুযোগ পান। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অস্থায়ী লেকচারার এবং ১৯৫৭ সালে পূর্ণকালীন লেকচারার হিসেবে যোগ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ ৩৬ বছরের। এই সময়ে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন, আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন এবং অবশেষে ১৯৮৩ সালের ৩১ অক্টোবর চূড়ান্তভাবে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরও তিনি শিক্ষাজীবনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন।

সাহিত্যকৃতি

আহমদ শরীফের সাহিত্যকর্ম প্রধানত মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল। তাঁর বিশ্লেষণমূলক চিন্তা ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ গবেষণা মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসকে আলোকিত করেছে। তাঁর রচিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ ‘লায়লী মজনু’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম মৌলিক গ্রন্থ ‘বিচিত চিন্তা’।

আহমদ শরীফ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, সুফি সাহিত্য, এবং বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর প্রণীত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • বিচিত চিন্তা
  • স্বদেশ চিন্তা
  • কালিক ভাবনা
  • যুগ যন্ত্রণা
  • বিশ শতকের বাঙালি
  • স্বদেশ অন্বেষা
  • মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ
  • বাংলার সুফি সাহিত্য
  • বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা

দর্শন ও মতাদর্শ

আহমদ শরীফের চিন্তাভাবনা এবং লেখনীতে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মাকর্সবাদের যৌগিক সমন্বয়। তিনি সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, সংস্কার এবং বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি তাঁর আস্থা ছিল দৃঢ়। পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন এবং ইতিহাসের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তিনি লেখনী চালিয়ে গেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে সমাজ পরিবর্তনের এক দৃঢ় প্রত্যাশা প্রকাশ পায়, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

আহমদ শরীফ ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর মরণোত্তর দেহদান ও চক্ষু দানের ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, তাঁর দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দান করা হয়।

আহমদ শরীফের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্বদেশ চিন্তা সংঘ কর্তৃক ড. আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতা ও পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে, যা প্রতি বছর প্রদান করা হয়।

আহমদ শরীফ ছিলেন একজন অসামান্য বুদ্ধিজীবী, যিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আজও স্মরণীয়। তাঁর চিন্তা ও লেখনী আমাদের চিন্তাশীলতার বিকাশে অমূল্য অবদান রেখে গেছে, যা ভবিষ্যতেও প্রেরণা যোগাবে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী মহিলা কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য, মানবিক অনুভূতি, প্রেম, বিরহ, এবং সমাজের বিভিন্ন দিকগুলো

Read More

মুহম্মদ আবদুল হাই এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মুহম্মদ আবদুল হাই (২৬ নভেম্বর ১৯১৯ – ৩ জুন ১৯৬৯) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক। তার গবেষণা এবং কর্ম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

Read More

ন্যায় দর্শনের বিষয়বস্তু: ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? ন্যায় দর্শন কী বা কাকে বলে? ন্যায় দর্শনের কয়টি শাখা ও কি কি?

ন্যায়দর্শন হচ্ছে ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম একটি দর্শন। ন্যায়দর্শন হল সেই ভিত্তি যার উপর ভারতের উচ্চতর দর্শনগুলি নির্মিত হয়েছে। ন্যায় দর্শনের প্রবক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি

Read More

বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৮ সালের কার্তিকে, ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায়। কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে। নজরুলের বিদ্রোহী

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.