শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ তারিখে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপুরুষের নিবাস ছিল উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকট মামুদপুরে। তার পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। মাতার পূর্বপুরুষ গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার ভাগলপুর নিবাসী ছিল। শরৎচন্দ্রের শৈশব ভাগলপুর শহরে কেটেছিল, কারণ দারিদ্র্যের কারণে তার পরিবার সেখানে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করত। শরৎচন্দ্রের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে দুই ভাই প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র এবং এক বোন সুশীলা দেবী ছিলেন।
শিক্ষাজীবন
শরৎচন্দ্রের শিক্ষা জীবন বেশ যাত্রাক্রমের। পাঁচ বছর বয়সে তাকে দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে ভাগলপুরে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৮৭ সালে ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হলেও ১৮৮৯ সালে পিতার চাকরি চলে গেলে স্কুল ত্যাগ করতে হয়। হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হলেও ফি পরিশোধ করতে না পারার কারণে সেখানেও বেশিদিন টেকেননি। পরবর্তীতে তিনি তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন।
চাকরি ও সাহিত্যসৃষ্টির শুরু
কলেজ জীবন শেষে শরৎচন্দ্র ভাগলপুরে খেলাধুলা ও অভিনয়ে সময় কাটান। এই সময় সাহিত্য সভার আয়োজন করে তিনি নানা উপন্যাস ও গল্প রচনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বর্মা রেলওয়েতে চাকরি করতে যান। এই সময় তার লেখা গল্প ও উপন্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯১২ সালে দেশে ফিরে এসে ‘যমুনা’ পত্রিকার জন্য লেখা পাঠানোর মাধ্যমে তার সাহিত্যিক পরিচিতি শুরু হয়।
বৈবাহিক জীবন
বর্মায় চাকরি করার সময় শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শান্তি দেবী ও তাদের এক বছরের সন্তান রেঙ্গুনের প্লেগে মারা যান। পরে, মোক্ষদা নামে আরেক কন্যাকে বিয়ে করেন, যার নাম তিনি পরে হিরন্ময়ী দেবী রাখেন।
শেষ জীবন
মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়ার পানিত্রাস গ্রামে একটি মাটির বাড়িতে বাস করতেন। ১৯৩৭ সালে তার স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে অস্ত্রোপচারের পর তার মৃত্যু হয়।
সাহিত্যকর্ম
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হলো:
- বড়দিদি (১৯০৭)
- পরিণীতা (১৯১৪)
- দেবদাস (১৯১৭)
- শ্রীকান্ত (১৯১৭-১৯৩৩)
- গৃহদাহ (১৯২০)
- পথের দাবী (১৯২৬)
- শেষ প্রশ্ন (১৯৩১)
তাঁর লেখার মধ্যে নারী ও সমাজের সংকট, সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতা ও অনুভূতির গভীরতা উঠে এসেছে।
চলচ্চিত্রায়ণ
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। “দেবদাস”, “পরিণীতা”, “বড়দিদি” ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলি তার সাহিত্যিক কীর্তির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছে। বিভিন্ন ভাষায় তার উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপান্তরিত হয়েছে এবং বহু প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী তার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তার চরিত্র ও কাহিনী আজও পাঠকদের মনকে স্পর্শ করে।